গত দুই দিন থেকে ব্লগার গ্রেফতার আর প্রগতিশীল ‘আমার ব্লগ’ বন্ধকরা নিয়ে বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী বাঙালী কমিউনিটিতে তুলকালাম অবস্থা, বিশেষ করে অনলাইন আর সুশীল সমাজে। প্রগতিশীলরা সরকারের এ সিদ্ধান্তে মহা খাপ্পা; আর হেফাজতপন্থীরা প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে আবডালে মুচকি হাসছেন। ব্লগার গ্রেফতার নিয়ে আ’লীগের রাজনৈতিক খেলার কথা অনেকেই বলছেন, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আমার কথা গ্রেফতার আর ব্লগ বন্ধ করার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। গত কয়েকদিন আগে চরমপন্থা প্রচারের অভিযোগ তুলে সোনার বাংলাদেশ ব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
সাথে সাথে শফিউর নামে উগ্রবাদী ব্লগার এবং সোনা ব্লগের পরিচালককেও গ্রেফতার করে। তখনকার প্রতিক্রিয়া ছিল এখনকার প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকের ব্লগার গ্রেফতারের ও আমার ব্লগ বন্ধের প্রতিবাদ কারীরা তখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনতো দূরের কথা ফেসবুকেও দুকলম লেখেনি। বরং অনেকেই সরকারের পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে লেখালেখিও করেছিল। যা আজকে হেফাজতের পক্ষের লোকেরা করছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতালের মত অবস্থা, আমি ক্ষমতায় থাকলে হরতাল নাজায়েজ, হরতাল দেশের অর্থনীতি ধ্বংশ করে। আর বিরোধী দলে গেলে হরতাল ভাত-কাপড়ের মতই মৌলিক অধিকার!!!
আমি ধর্ম বিরোধী/অথবা ধর্মীয় উগ্রবাদী লেখা লেখলে তার প্রতিবাদ করা যাবে না, এটা মুক্তবুদ্ধির চর্চা, আরেকজন আমার মতের বিরোদ্ধে লেখলে তা মুক্তবুদ্ধির চর্চার অপব্যবহার, উগ্রবাদ/নাস্তিক্যবাদ প্রচারণামূলক লেখা।
এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ সেমিস্টারে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিযে একটি কোর্সর একটা ক্লাসের কথা মনে পড়ে গেল। স্বভাবতই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের তীব্র এবং রগরগে উত্তেজনার মত ক্লাসেও ব্যাপক ধর্ম নিয়ে বিতর্ক। পড়াশুনায় আমার মূল আগ্রহের বিষয় দুটি; উন্নয়ন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্মের রগরগে ভূমিকা দেখে এর প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বছরে এ নিয়ে অনেক পড়াশুনাও করে ফেলি। তো ধর্ম্ আর রাজনীতি কোর্সের ক্লাস সবসময় হাউসফুল থাকত। অন্যান্য ক্লাসে যে ছেলে/মেয়েটি কোন কথাই বলত না সেও হয়ে যেত এই ক্লাসের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। হয়ত স্যারের পড়ানোর স্টাইলের কারণেই এমন হত।
স্যার প্রথমে এসে টপিকের উপর পাঁচমিনিট কথা বলেই ফ্লোর সবার জন্যা ওপেন করে দিতেন। ক্লাসে আমিতো পুরাই অবাক। যে ছেলে বা মেয়ে ধর্মের নিয়ম শৃংখলার আশেপাশেও নেই, সেই দেখতাম ধর্মের পক্ষে বড়গলায় সাফাই গাচ্ছে। বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ধর্মের পক্ষে কথা বলছে। যাই হোক, একদিন সেই কোর্সের টপিক ছিল রাজনীতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্ম্।
যথারীতি ক্লাসে রমরমা অবস্থা, যুক্তি আর পাল্টা যুক্তি।
স্যারের প্রশ্ন ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ কতটা যুক্তিগ্রায্য। অনেকক্ষন ধরে যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলল। ক্লাসে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। একদল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাপক সমালোচনা।
অন্যগ্রুপ মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মকে নিয়ে কটুক্তির তীব্র বিরোধী। তো একপর্যায়ে স্যার আমার মতামত জানতে চাইলেন। আগে থেকেই স্যারের সাথে এই নিয়ে কথা হত, তাই স্যার জিজ্ঞেস করলেন তোমার মত বল।
আমি বললাম স্যার আমার কথা হল ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা’ ব্যাপারটা কি আগে ডিফাইন করতে হবে। ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চার অধিকার’ মানে যদি হয় যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার, তাহলে আমার কথা আছে..।
যদি এসবের মানে যা ইচ্ছা তাই বলার স্বাধীনতা হয়, তাহলে ধর্মবিরোধীদের যেমন ধর্মকে নিযে গালাগালি করার অধিকার আছে, ঠিক তেমনি আলকায়দারও বোমা মারার শিক্ষা প্রচারের অধিকার আছে। এই ক্ষেত্রে ধর্মবিরোধী মতপ্রকাশকদের যেমন অধিকার থাকা উচিত, আলকায়দা, শিবসেনা, কুক্লাক্সক্লানের ও আদের্শ প্রচারের অধিকার কে স্বীকার করতে হয়। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে উগ্রধর্মবিরোধী আর উগ্রধর্মপন্থী দুই গ্রুপের প্রকৃতি একই। এখানে আলকায়দা বা প্রতিক্রিয়াশীল আর উগ্র-প্রগতিশীল একই কাতারের মানুষ। এখন আপনি বলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা অথবা মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে আপনি কতটা অধিকার দিতে রাজী আছেন।
স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আসলেই জটিল প্রশ্ন, সবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন তোমাদের কি মত? বলাবাহুল্য ঔদিন প্রতিক্রিয়াশীল আর প্রগতিশীল কেউই কোন উত্তর দিতে পারে নাই।
আজকেও ‘মুক্তবুদ্ধি’ আর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যাপক ঘোলাটে মনে হচ্ছে... “মুক্তবুদ্ধী চর্চার অধিকার “ মানে যদি হয় যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার, তাইলে আমার কথা আছে..
মুক্তবুদ্ধী চর্চা তত্ত্বের নিয়ম অনূযায়ী ধর্মবিরোধী লেখা লেখে ধর্মপন্থীদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যদি জায়েজ হয় তাহলে আল কায়দা আর শিবসেনার মতবাদকেও মুক্তবুদ্ধী তত্ত্বের নিয়ম অনূযায়ী ‘জায়েজ’ বলতে হবে তাদেরকে তাদের মতপ্রকাশের সমান সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের বুদ্ধীজীবীরা যদি নাস্তিক্যবাদী উগ্রবাদকে সমর্থন করে থাকেন, তাহলে তারা আস্তিক্যবাদী উগ্রবাদকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন.....উগ্রবাদ, উগ্রবাদই, তা যে ফরম্যাটএই হোক না কেন?
এখন আসেন আসল কথায়,
ধর্ম নিয়ে দুনিয়াতে দুই ধরনের উগ্রবাদ আছে, একটা হল ধর্মপন্থী উগ্রবাদ আর অপরটা হল ধর্মবিরোধী বা নাস্তিক্যবাদী মৌলবাদ..
আপনি ধর্মপন্থী তাই বলে বোমা মেরে জোর করে আরেক জনকে ধর্ম মানাতে হবে কেন? আপনার কাজ হল ধর্মের বাণী আরেক জনের কাছে সুন্দর ভাবে, যুক্তিগ্রায্য উপায়ে তুলে ধরা। তাতে সে ধর্মকে মানলে মানবে, না মানলে না মানবে, তাতে আপনার ক্ষতি হওয়া কথা নয় (অন্ত:ত আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তাই মনে হয়। ভুল হলে হতে পারে।
কারণ ধর্মের নিয়ম কানুন সম্পর্কে আমার জ্ঞান নিতান্তই এ বি সি ডি!!)
একই ভাবে..
নাস্তিক ধর্মের অনুসারী হইছেন তাই বলে ধর্মকে গালি দিতে হবে, ধর্ম প্রচারকদের নিযে যাচ্ছেতাই লেখতে হবে, এটা কে বলল?? আপনি আল্লাহ-খোদায় বিশ্বাস করেননা, ভাল কথা, তাই বলে ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়া এত মাতামাতি করার কি আছে। আপনার মতামত সুন্দর ভাবে, যুক্তির মাধ্যমে আস্তিকের কাছে তুলে ধরেন। তাতে সে যদি আপনার মতামত মানে তাহলে মানল, না মানে না মানল, তাতে তো আপনার দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে না।
আস্তিক উগ্রবাদী আর নাস্তিক উগ্রবাদী একই কাতারের মানুষ… দুইগ্রুপেরেই সমান শাস্তি হওয়া উচিত।
দুই দলই সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী… ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।