কি বলব ছোটবেলায় সৌজন্য আর শুভবুদ্ধির কথা শুনেছি, ‘অন্ধকে অন্ধ আর খঞ্জকে খঞ্জ বলিতে নাই, তাহাতে তাহাদের মনে দুঃখ হয়। ’ বড় হয়ে দেখেছি, শিশুকেও সব সময় শিশু বলতে নেই, তাদের নাকি আত্মসম্মানে আঘাত লাগে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবস্থাও সেরকম। হক-কথা তাদের ভালো লাগে না। মিডিয়ার স্বাধীনতার কথাই দেখুন।
দেশে-বিদেশে তারা প্রচার চালাচ্ছে, মিডিয়াকে তারা সব রকমের স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে তারা বোকা না ভাবলেই পারত। দেশের মানুষ প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে পারে। আসলে সে পরিস্থিতি তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
একশ্রেণীর পত্রিকা আর টেলি-চ্যানেল আছে যারা সব সময় সরকারের কানে মধুবর্ষণ করে।
তারা সরকারের কাছ থেকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায়। শুনেছি, তাদের অনেকে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে। মিডিয়ার যে ছোট তরফ মধুবর্ষণে শরিক হতে পারছে না, তারা একটা ত্রাসের রাজত্বে বাস করছে। সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকছে তারা। দুঃসহ একটা সেল্ফ সেন্সরশিপে ভুগছে তারা।
যে কোনো মুহূর্তে সরকারের নির্যাতন ১০ টন পাথরের মতো তাদের মাথায় আঘাত হানতে পারে। গুণীজনরা যথার্থই বলে থাকেন, সেল্্ফ সেন্সরশিপ প্রকাশ্য সেন্সরশিপের চাইতে বহুগুণ জঘন্য।
মধুবর্ষণে অক্ষম মিডিয়ার ক্ষুদ্র অংশ আরেক রকমের সেন্সরশিপে ভুগছে, যেটাকে বলা যায়, পাশবিক সেন্সরশিপ। তার চেহারাও প্রায়ই দেখতে পারছে বাংলাদেশের মানুষ। গত বছরের মার্চ মাসে লন্ডনের ব্রিকলেনে কয়েকজন লোক দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর আক্রমণ করে।
২০ মার্চ (২০১০) লিখিত এবং পত্রান্তরে প্রকাশিত কলামে আমি লিখেছিলাম, মাহমুদুর রহমান এবং তার পত্রিকার বিরুদ্ধে আক্রমণ নতুন নয়। বাংলাদেশে তার ওপর অনেকগুলো হামলা হয়েছে, তার গাড়ির ক্ষতি করা হয়েছে। বর্তমান সরকার এবং শাসক দল আইন ও আদালতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। তারা আইনের নামে বিরোধীদের চরিত্রহনন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। অবশ্যই সরকারি অনুপ্রেরণায় ২৭টি মানহানি মামলা দিয়ে মাহমুদুর রহমানকে যেন থেঁতলে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
আমার দেশ পত্রিকার একজন বিশেষ সংবাদদাতাকে ইট ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তার গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে। ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে, আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরাই বাংলাদেশের মতো লন্ডনের সড়কে, লন্ডন পুলিশের নাকের ডগার ওপর মাহমুদুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।
এত আগ্রাসনের কারণ কী? কারণ আমার দেশ পত্রিকায় এ মর্মে একটা অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছিল—একটি মার্কিন তেল কোম্পানিকে বিনা টেন্ডারে ও অনিয়মিতভাবে মোটা অঙ্কের কনট্রাক্ট পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় পাঁচ কোটি ডলার ‘বখশিশ’ পেয়েছেন। সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সতর্ক প্রহরী বলা হয়।
অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টাও সংবাদপত্রের ভূমিকার মধ্যে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তখন সে সম্বন্ধে মনোযোগ আকর্ষণ করা অবশ্যই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের কর্তব্য। সে কর্তব্য পালনের কারণে একটি পত্রিকা, একজন সংবাদদাতা আর একজন খ্যাতনামা ও সম্মানিত সম্পাদকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও হত্যার প্রচেষ্টার যথেষ্ট নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই।
পরবর্তী পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা আছে। আদালত মাহমুুদুর রহমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিলেও নয় মাস তাকে কয়েদ করে রাখা হয়েছে।
এমনই সাংঘাতিক এ সরকারের প্রতিশোধ বাসনা ও জিঘাংসা। এদিকে নিরপেক্ষভাবে যারা সাংবাদিকতা করতে চান, প্রায়দিনই দেশের কোথাও না কোথাও তাদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িমিছিলে হামলায় যারা আহত হয়েছেন, তিন সাংবাদিকও আছেন তাদের মধ্যে। তার মাত্র ক’দিন আগেই বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে হত্যার দায়ে প্রাণদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লবকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত আবু তাহেরের লোকেরা মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে বিপ্লবের দণ্ডমুক্তি উদযাপন করছিল।
এই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশের করুণ চিত্র।
পানি ছাড়া ইফতার, অন্ধকারে সাহরি
প্রধানমন্ত্রী আড়াই বছর আগে ডিজিটাল আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি বলছেন মানুষকে বিদ্যুত্ এবং পানি কম ব্যবহার করতে। বিদ্যুত্ বলতে গেলে অমাবস্যার চাঁদের মতোই বিরল। খাবার পানির অবস্থাও সে রকম।
এই রোজার দিনে মানুষ ইফতারে কম করে পানি খাবে, অন্ধকারে সাহরি খাবে—সেটাই যেন বলতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। অপদার্থ বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল ফারুক খান আড়াই বছর ধরে বলে আসছেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম সামালের মধ্যে আছে, সামালের মধ্যে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি ব্যবসায়ীদের হুশিয়ার করে দিয়েছেন, সুতরাং রোজার দিনে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু কার হুশিয়ারি কে শোনে? মজুতদারি আর কালোবাজারি করছে সরকারের নিজের লোকেরা। কারও হুশিয়ারির পরোয়া তারা করে না।
সুতরাং মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে আর ঘটছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী এখন মানুষকে বলছেন, কম করে খেতে। তিনি যেন বলতে চাইছেন সাধারণ মানুষ আদৌ না খেয়ে থাকতে পারলে আরো ভালো। এদিকে বাংলাদেশে জোর গুজব—বাণিজ্যমন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির উদর বেলুনের মতো স্ফীত হয়েই চলেছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।
আড়াই বছর পরে (অসাধু উপায়ে অর্জিত সম্পদ এদিক-ওদিক সরিয়ে ফেলার সুযোগ দিয়ে) প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, মন্ত্রীরা সম্পদের হিসাব তার কাছে দেবেন, কিন্তু সে হিসাব প্রকাশ করা হবে না। এসব খবর বিদেশি মিডিয়ায় প্রকাশ করা হলে কী লিখবে বা বলবে তারা?
সরকারের কপাল ভালো। ২০০৮ সাল থেকে পশ্চিমা বিশ্ব ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছে। বিদেশে সংবাদদাতা পাঠানোর সাধ্য অধিকাংশ মিডিয়ারই নেই। তাছাড়া আমেরিকায়, ইউরোপে আর মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর গরম খবর ঘটছে।
বাংলাদেশের মতো ভাগ্যহত দেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের কোথায়? অতএব শেখ হাসিনার সরকার বলতে গেলে বিশ্ববাসীর দৃষ্টির আড়ালেই অশাসন-কুশাসন আর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল।
সরকারের এই আরাম-আয়েশের শাসনে বাদ সাধল সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকা। ইকোনমিস্টের সুনাম দুনিয়াজোড়া। বহু দেশের মন্ত্রী এবং সরকার-প্রধানও নিয়মিত ইকোনমিস্ট পড়েন বলে শুনেছি। ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের ওপর পরপর দুটো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তাতে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তিনি বিস্ফোরণে ফেটে পড়েছেন বললেই বোধহয় বেশি সঠিক হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এত উষ্মার কারণ কী? প্রবন্ধে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোকে বাংলাদেশের গরিষ্ঠ মানুষ ‘হক-কথা’ বলেই বিবেচনা করবে। কিন্তু সেই যে বলছিলাম গোড়াতে, ‘অন্ধকে অন্ধ, খঞ্জকে খঞ্জ আর শিশুকে শিশু বলিতে নাই!’
ইকোনমিস্ট প্রথম প্রবন্ধে লিখেছিল, ইন্দিরা গান্ধীকে মরণোত্তর সম্মাননা দিয়ে সরকার নিজে নিজে উল্লাসে আপ্লুত হচ্ছে, কিন্তু স্বাধীনতার আসন্ন চল্লিশতম বার্ষিকী নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো উত্সাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘ভারতের ব্যাগভর্তি (বিপুল) অর্থ আর উপদেশের সাহায্যে’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট জয়ের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ফুলে ফুলে বিকশিত হয়েছে, উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের উল্লাসের কারণ সৃষ্টি করেছে।
থলেভর্তি টাকা এবং গোপন পরামর্শ
বাংলাদেশের পাঠকদের অবশ্যই মনে থাকার কথা যে, ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর দেশজোড়া একটা অবিশ্বাসের ছায়া নেমে এসেছিল। পরপর তিনবার যে বিএনপি গরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিল, সে বিএনপি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েও মাত্র গুটিকয়েক আসন পেয়েছিল সংসদে। একটা কথা লোকের মুখে মুখে ঘুরছিল যে দেশজোড়া একটা ‘মাস্টার প্ল্যানের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী বিজয় দেয়া হয়েছিল। সে মাস্টার প্ল্যানে ভারত-মার্কিন, বিশেষ করে ভারতের ভূমিকা নিয়েও প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে তখন। নির্বাচনী অভিযানের সময় বিভিন্ন স্থানে বিএনপির স্থানীয় কর্মীরা অভিযোগ করেছিলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই তৃণমূল স্তরে বিএনপিকে ভোট না দিতে জনসাধারণকে এবং ভোটকেন্দ্রে না যেতে বিএনপির এজেন্টদের ভয় দেখিয়েছিল।
অবশ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা ২০০৫ সাল থেকেই দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। প্রথমে হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ও পরে হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তী বলতে গেলে প্রতিদিনই সুধা সদনে আনাগোনা করেছেন। নিশ্চয়ই সুধা সদনের চায়ের গুণগত উত্কর্ষে আকৃষ্ট হয়ে তারা সে ঠিকানায় এত ঘন ঘন যাতায়াত করেননি! সাধারণ মানুষ তাদের এ সন্দেহ গোপন রাখার চেষ্টা করেনি যে, ভারতীয় দুই রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছু একটা ষড়যন্ত্র পাকানোর চেষ্টা করছেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে শত শত বাসবোঝাই লগি-লাঠি-বৈঠাধারী যে ঢাকায় এসেছিল সে বাবদ টাকার থলিগুলো কোথা থেকে এসেছিল? বাংলাদেশে র’য়ের যে বেতনভুক ছয় লাখ তিন হাজার এজেন্ট আছে বলে শোনা যায়, তারা কি কোনো ভূমিকা রাখেনি দিনের পর দিন দেশ অচল করে দেয়ার ব্যাপারে?
প্রসঙ্গত, আরেকটা কথা এখানে। শেখ হাসিনার সরকার কথায় কথায় ‘বিচার বিচার’ ধ্বনি তোলে।
হাইকোর্টেরও কোনো কোনো বিচারপতি এখন একযোগে ফরিয়াদির ভূমিকাও পালন করছেন। কর্নেল তাহেরের মামলা প্রসঙ্গে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও তদন্ত হওয়া উচিত বলে তারা অভিমত দেন, মুফতি মতিউর রহমান নিজামীর জামিনের শুনানিতে তারা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও অভিযোগের উস্কানি দেন। ‘বিচার বিচার‘ বলে যারা মুখে ফেনা তুলছেন তারা এখনও ২০০৬ সালের লগি, লাঠি আর বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্যে সড়কে পিটিয়ে মারা আট ব্যক্তির বিচার সম্বন্ধে একটি কথাও বলেননি, তাদের জিহ্বা যেন বিড়ালে খেয়েছে।
এই যেখানে অবস্থা সেখানে ‘ভারতের থলেভর্তি নগদ টাকার আর ভারতের পরামর্শের’ কথা বলে ইকোনমিস্ট কোথায় মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলল, তা বাংলাদেশের মানুষের বোধগম্য হবে না। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার ‘আন্দোলনের ফসল’ এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের সব কাজ তিনি বৈধ করে দেবেন।
জেনারেল মইন সাত দিনের ভারত সফরে গেলেন, বিধিনিষেধের মাথা খেয়ে ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে গোপন শলা-পরামর্শ করলেন এবং ছয় ঘোড়া উপহার নিয়ে দেশে ফিরলেন। তারপর ডিজিএফআইকে দিয়ে বিএনপির দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেজন্যেই বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে, বিগত নির্বাচন কিংবা সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় কোনোটাই বৈধ ছিল না।
করিডোর কেন সর্বনাশ ডেকে আনবে
ইকোনমিস্টের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দু’দেশের সম্পর্ক লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নত হচ্ছে।
ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা দেয়ার পরে ভারতীয় কর্মকর্তারাও বলেছেন, দু’দেশের সম্পর্ক এখন ‘খুবই চমত্কার’ এবং সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। বাংলাদেশ ভারতকে যে করিডোর দিতে রাজি হয়েছে সেকথা উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এর ফলে ভারত আরও সহজে নাগাল্যান্ড ও মনিপুরের বিদ্রোহীদের দমন করতে পারবে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, হিমালয়ের ওপর অরুণাচলে চীনের সীমান্তের কাছে মোতায়েন ক্রমবর্ধমান ডিভিশনগুলোকে সরবরাহ পাঠানোর জন্যে ভারত (বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে) করিডোরগুলো ব্যবহার করতে চেষ্টা করবে।
ভারতীয় মিডিয়ার খোঁজখবর যারা রাখেন তারা অবশ্যই জানেন, তারাও এখন বাংলাদেশ সরকারের অতিমাত্রিক বদান্যতার কথা বলতে শুরু করেছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় এক ভাষ্যকার তো লিখেছেন যে, কোনো কিছু চাইবার চিন্তা ভারতের মাথায় আসার আগেই বাংলাদেশ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেটা দিয়ে দিচ্ছে।
করিডোরের বিষয়টি সব চিন্তাশীল বাংলাদেশীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বহু কারণ আছে তার। প্রথমত, শিলিগুড়ি হয়ে তথাকথিত ‘চিকেন নেক’ (মুরগির গলা) নামের সরু সংযোগপথটি উত্তরপূর্বের সাতটি রাজ্যের (তথাকথিত সেভেন সিস্টার) স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা অতীতে বহুবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষ নতুন করে দেখা দিলে চীনারা প্রথম চোটেই সে সংযোগপথ বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত সৈন্য, কামান, গোলাগুলি ইত্যাদি বাংলাদেশের ভেতরের করিডোর দিয়ে পাঠাতে বাধ্য হবে।
বস্তুত, সেজন্যেই ভারত বিশেষ করে করিডোর চায়। অনেকগুলো মারাত্মক বিপদ আছে তাতে বাংলাদেশের জন্যে। সেভেন সিস্টারের মুক্তিযোদ্ধারা যদি বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে অস্ত্রবোঝাই ভারতীয় ট্রাক কিংবা ট্রেন উড়িয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের কি ব্যাপক ক্ষতি হবে না? তেমন আশংকা প্রতিরোধের জন্যে ভারত যদি বাংলাদেশে সৈন্য পাঠায় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কিংবা সার্বভৌমত্ব কি পদদলিত হবে না? তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অরুণাচলে সৈন্য কিংবা অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হলে চীন কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তাছাড়া ভারতীয় জনতা পার্টির চিন্তাবিদ সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামী মাত্র দিনকয়েক আগে বলেছেন, সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত সরলরেখার ভারতের দিকের অংশটি ভারতকে দখল করে নিতে হবে। ভারতের আগামী নির্বাচনে বিজেপি যে ক্ষমতায় আসবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের মতো ভৌগোলিক অখণ্ডতাও কি শেখ হাসিনার সরকার বিসর্জন দিতে যাচ্ছে?
কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন
ইকোনমিস্টের প্রবন্ধ দুটিতে বাংলাদেশের বিচার পদ্ধতি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে কার্যত সরকারবিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলকে বিধ্বস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।
বর্তমান বিচার ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষের আস্থা আছে কিনা সন্দেহ। আর যুদ্ধাপরাধের বিচার? কানা ছেলের পদ্মলোচন নামের মতো এ ট্রাইবুন্যালের নাম দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল। কোন যুক্তিতে এটা আন্তর্জাতিক হলো? অন্য কোনো দেশের বিচারক কিংবা আইনজীবী আছে, এ ট্রাইবুন্যালে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ভারত ছাড়া আর কোনো দেশই এই ট্রাইবুন্যালের বিচার পদ্ধতি, এমনকি যে আইনে এই ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়েছে সেটাকে বৈধ বিবেচনা করে না।
লর্ড এইভবেরি এতকাল আওয়ামী লীগের প্রিয় অভিভাবক বিবেচিত হতেন। আওয়ামী লীগের উত্সাহে তিনি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের যুগ্ম চেয়ারম্যান হয়েছেন।
মাত্র গত ২৭ জুলাই তিনি আইনমন্ত্রী শফিক উদ্দিনকে বলে দিয়েছেন যে, তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল বাংলাদেশের আইনও মেনে চলছে না, আন্তর্জাতিক আইন তো নয়ই। লর্ড এইভবেরি আইনমন্ত্রীকে আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এ ট্রাইবুন্যালের চেয়ারম্যান ১৯৯২ সালে শাহরিয়ার কবিরের গণআদালতের একজন উত্সাহী পাণ্ডা ছিলেন। অর্থাত্ লর্ড এইভবেরি বলতে চেয়েছেন, এই চেয়ারম্যানের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার হবে বলে আশা করা যায় না।
আরেকটা কথা এখানে বাংলাদেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে তখন তাকে (শেখ মুজিব) সমর্থন করার জন্যে প্রবাসী বাংলাদেশীরা চাঁদা করে একজন ব্রিটিশ আইনজীবী পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের সমর্থন করার জন্যে ব্রিটিশ আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যান ঢাকা গেলে তাকে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি, সারাদিন বিমানবন্দরে আটকে রেখে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা যে অধিকার শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়েছিল, সে অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের দিতে শেখ হাসিনার সরকার অস্বীকার করল।
এতকিছুর পরে বিদেশিরা যদি মনে করে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কিংবা সুবিচার নেই, তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যাবে? বিদেশিদের এ ধারণারই প্রতিফলন দেখা গেছে ইকোনমিস্টের প্রবন্ধ দুটিতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কেন ক্রুদ্ধ এবং বিস্ফোরিত হয়েছেন সেটা গোড়াতেই বলেছি। বাংলাদেশের বৈদেশিক প্রচার অধিকর্তা একটা প্রতিবাদের চিঠি পাঠিয়েছেন ইকোনমিস্টকে।
দীপু মনি হুমকি দিয়েছেন, সে চিঠি ছাপা না হলে তিনি বিকল্প ব্যবস্থা নেবেন। ইকোনমিস্ট সে চিঠি তাদের অন-লাইন সংস্করণে রেখেছে, মুদ্রিত সংস্করণে ছাপেনি। দীপু মনি কি করবেন এখন? কোনো ব্রিটিশ আদালতে সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের বিরুদ্ধে মামলা করবেন? খুব ভালো হবে তাহলে, আজকের বাংলাদেশের ভেতর কী হচ্ছে সারা বিশ্ব সেটা সবিস্তারে জানার সুযোগ পাবে।
এদিকে বাংলাদেশের সব গণতন্ত্রকামী এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সপক্ষের নাগরিককে জরুরিভাবে কিছু বিষয় ভাবতে হবে। ঈদের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসছেন।
ভারতকে করিডোর দেয়াসহ আরও একপ্রস্থ গোপন চুক্তি তখন স্বাক্ষরিত হবে বলে আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া এবং অন্য সব স্বাধীনতাপ্রিয় ও গণতন্ত্রকামী দলের নেতাদের এক্ষুনি ঘোষণা করতে হবে যে, পূর্বাহেপ্ত বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ না করে এবং দেশবাসীর অনুমোদন না নিয়ে কোনো চুক্তিতে সই করা হলে সেসব চুক্তি তারা মানবেন না। তাদের সবাইকে বলে দিতে হবে, গোপন ও ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তিতে সই করার জন্য সফরে এলে মনমোহন সিং কার্যত ঔপনিবেশিক শাসকের মতোই আসবেন, বাংলাদেশের মানুষের অন্তরের অভ্যর্থনা তিনি পাবেন না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।