সেনাবাহিনীর একটা অংশকে প্রলুব্ধ করেছে একটি গোষ্ঠী। যারা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপক্ষে। ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির যে কাজগুলো হচ্ছিল, এটা সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আমার অগোচরে ছিল। গোচরে আসার জন্য যে সংস্থা কাজ করেছিল, তারা সেনাপ্রধান হিসেবে সেই সংবাদ আমাকে দেয়নি। আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর জানতে পারি ১৫ আগস্ট ভোরে। এর আগে কিছুই জানতাম না। ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির এ খবরগুলো দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা ফেল করেছে। যেমন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও তারা কিন্তু কর্তৃপক্ষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে আমি সেনাপ্রধান হিসেবে যখন জানতে পেরেছি, তখনই অধীনস্থ কমান্ডারকে নির্দেশ দিয়েছিলাম এটা প্রতিরোধ করার জন্য। আমি ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেও, তিনি সেই নির্দেশ পালন করেননি। তিনি করেননি বিধায় এ রকম হত্যাকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। অনেকে বলেন সেনাপ্রধান হিসেবে আমি কেন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি বলতে চাই- এখানে সেনাপ্রধানের একার দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করার। এখানে আরও অন্য এজেন্সি আছে। সেই এজেন্সির কাছে কেউ কখনো জানতে চায়নি, কেন রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা গেল না। কিন্তু আমি যখন সকাল সাড়ে ৫টার দিকে জানতে পেরেছি, তখনই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। পাশাপাশি আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি, তাতে আমার ধারণা, ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার কেন নির্দেশ শোনেননি, তা খতিয়ে দেখা। যদিও এখন তিনি মৃত।
অনেকে মনে করেন বঙ্গবন্ধু আমাকে সেদিন সকালে টেলিফোন করেছিলেন। আসলে বঙ্গবন্ধু আমাকে টেলিফোন করেননি। বরং আমিই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন সকাল ৬টা বাজার ৫-৬ মিনিট আগে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। আমি টেলিফোন করে বঙ্গবন্ধুকে পেতে প্রায় ২৫ মিনিট লাগে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই কারও না কারও সাহায্য পেতে টেলিফোন করেছিলেন। আমাকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করেননি এ জন্য যে তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু যখন দেখলেন সেনাবাহিনীর সদস্য দ্বারা তিনি আক্রান্ত, তখন হয়তো আমার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। তাই হয়তো তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি। কিন্তু আমার টেলিফোন পাওয়ার পর হয়তো সেই সন্দেহটা দূর হয়েছিল। কারণ তার সঙ্গে যখন আমার যোগাযোগ হয়, তখন তিনি আমাকে রাগান্বিত স্বরে বলছিলেন, সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধহয় মেরেই ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। আমি বললাম, স্যার আমি কিছু করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন? উনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আমি হ্যালো হ্যালো করছি। এর প্রায় ২০-৩০ সেকেন্ড পর আমি কিছু গুলির আওয়াজ শুনলাম। এরপর টেলিফোন কেটে গেল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্য দিয়ে আমি দুটি ক্ষোভ লক্ষ্য করেছি। এর একটি হলো_ সফিউল্লাহ সেনাবাহিনী আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। বঙ্গবন্ধুর যে আস্থাহীনতা ছিল, তা তিনি ফিরে না পেলে তো এই কথা আমাকে বলতেন না। আমার সান্ত্বনা শুধু এটাই যে সবাই একদিন না একদিন চলে যাব, বঙ্গবন্ধুও চলে গেছেন। কিন্তু তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে হয়তো সেই বিশ্বাস তিনি ফিরে পেয়েছিলেন। যদি ফিরে না পেতেন, তাহলে হয়তো এই কথাগুলো বলতে পারতেন না_ 'সফিউল্লাহ তুমি ফোর্স পাঠাও'। রক্ষীবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারার কারণ হলো, এই কাজের জন্য যেসব অস্ত্র দরকার ছিল, তা তাদের হাতে ছিল না। এটা শুধু সেনাবাহিনীর কাছে ছিল। সেনাবাহিনীকে দেখে হয়তো অনেকে ভয়ে কাছে আসেনি। তাদের হাতে রাইফেল ছিল কিন্তু গুলি ছিল না। গুলি ছিল বিডিআর কোয়ার্টার গার্ডে। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তাকে বাঁচাতে সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতা সম্পর্কে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, তা সঠিক নয়। আমি মনে করি, কোনো মহল সেনাবাহিনীকে দোষারোপ ও আমাকে ছোট করতে এ অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে বিডিআর বিদ্রোহ হয়, ওই সময় কিন্তু বিডিআর মহাপরিচালক প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারেননি। না পারার কারণ হলো, যারা হত্যাকারী ছিল, তারা তাদের ওপর অস্ত্র ঠেকিয়ে কথা বলেছে। ওই সময় তাদের রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মেজর ডালিম আমার অফিসে ঢুকে আমার দিকে অস্ত্র তাক করে। ওই সময় আমার সামনে জেনারেল জিয়া এবং খালেদ মোশাররফ বসা ছিল। জেনারেল নাসিম পাশে দাঁড়ানো ছিল। আমি তখন বলেছিলাম, আমি এই অস্ত্র দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তুমি যদি ব্যবহার করতে এসে থাক তাহলে ব্যবহার কর। আর যদি কথা বলতে এসে থাক, তাহলে অস্ত্র এবং তোমার লোক বাইরে রেখে এসে কথা বল। তখন সে অস্ত্র নিচের দিকে নামিয়ে বলে, রাষ্ট্রপতি আপনাকে রেডিও স্টেশনে ডেকেছেন। আমি বললাম, রাষ্ট্রপতি তো মারা গেছেন। তখন ডালিম বলে, স্যার আপনার তো জানা উচিত খন্দকার মোশতাক এখন রাষ্ট্রপতি। তখন আমি বলেছি, তিনি তোমার রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, আমার নয়। আমার এ কথা শুনে ডালিম আমাকে বলে, স্যার আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না, যা আমি করতে এখানে আসিনি। তখন আমি ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে তার অস্ত্রের ব্যারেলের মধ্যে হাত রেখে বলেছিলাম, তোমার যা করার খুশি করতে পার, আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাব না। এই বলে আমি আমার চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের চারপাশ ঘুরে দরোজার দিকে বেরোই। আমি তখন তাদের ১৭-১৮ জন সৈন্যের সামনে দিয়ে গাড়িতে উঠি। ডালিম ও তার সৈন্যরা আমার পেছনে পেছনে আসে। তারা আমার গাড়ি নির্দেশনা দিয়ে ঢাকা ব্রিগেডে নিয়ে যায়, যাদের আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য। তখন আমার আরও মনে হয়েছিল, এজেন্সিগুলো খবর সংগ্রহের কাজ না করে অন্য কাজ করেছিল। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটা আক্রমণ হচ্ছে- এ খবরটা তাদের কাছে থাকবে না? এটা হতে পারে না। আমি তো মনে করি, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে এজেন্সিগুলোও সম্পৃক্ত ছিল। ঢাকা ব্রিগেড থেকে তারা আমাকে শাহবাগে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। ওইখানে তখন খন্দকার মোশতাক একটা গোলটেবিলের পেছনে বসা ছিলেন। তার সঙ্গে তাহের উদ্দিন ঠাকুর। খন্দকার মোশতাক আমাকে বললেন, সফিউল্লাহ, কনগ্রাচুলেশন্স, ইউর ট্রুপস হ্যাভ ডান এ ওয়ান্ডারফুল জব। নাউ ডু দ্য রেস্ট। আমি বললাম, হোয়াট রেস্ট? উনি বললেন, ইউ শুড নো ইট বেটার। আমি বললাম, লিভ ইউ টু মি। এ কথা বলে আমি দরোজা দিয়ে বের হওয়ার উদ্যোগ নিই। তখন তাহের উদ্দিন ঠাকুর বললেন, উনাকে থামাও। উনাকে আমাদের দরকার। আমাকে দরোজার কাছে থামানো হলো। তাহের উদ্দিন ঠাকুর একটি কাগজে কিছু একটা লিখে আমার সামনে তুলে ধরেন। তাতে লেখা ছিল, আমরা যেন সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করি। এরপর আমি সেখান থেকে চলে আসি। এ সময় খন্দকার মোশতাক বললেন, আমি চাই ১০টার মধ্যে আমার চিফরা (তিন বাহিনীর প্রধানরা) যেন বঙ্গভবনে থাকেন। সেখানে রাষ্ট্রপতির শপথ হবে। আমাদের মনের মধ্যে তখন চিন্তা ছিল, বঙ্গবন্ধু নেই। কিছু করতে চাইলে সৈন্যও নেই। এগুলো মাথায় রেখেই আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নিই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।