আজ আমি আমার জীবন বৃত্তান্ত লিখছিলাম। একটা চাকরীর আবেদন করতে চাই। যেখানে আবেদন করবো তাদের নিজস্ব ফরমেট আছে। সেখানে আমাকে আমার অতীত জীবনের অনেক কাজের কথা লিখতে হলো। আমার অর্জনের কথা লিখতে হলো।
এই লিখতে যেয়ে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। ১৯৯৯ সাল। আমি তখন আমার প্রতিষ্ঠান নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। আমি ফান্ড পাচ্ছি না। এ দিকে জিদ করেছি চাকরী করবো না।
যে কোন মূল্যে আমার প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলবো। তাই মরণপণ করে নেমেছি। বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করেই ছাড়বো। যাহোক অগ্রণী ব্যাংকের আপা ডিজিএম জনাব আখতার আয়শা খানম তার পরীবাগের অফিসে আমাকে ইউ এন ডি পি-র প্রতিনিধিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের অফিস কুয়ালালামপুরে।
আমার সাথে আলাপ হলো। আমি ক্ষুদ্র নারী শিল্পদ্যোক্তাদের উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শেষে ব্যবসা শুরু করা অথবা বাড়ানোর জন্যে পুঁজি সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে অগ্রণী ব্যাংকের সাথে লিংক করে দেই। ব্যাংক তাদেরকে ঋণ দেয়। অবশ্যই ১০০% ঋণ পরিশোধের জামানত আমি দেই। এঁরা আমার কথা শুনলেন।
এরপর তাদের অন্যান্য কাজ সেরে নিজ দেশে ফিরে গেলেন।
কিছুদিন পর আমি তাদের কাছ থেকে একটা আমন্ত্রণ পেলাম। মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াংগুনে একটি সেমিনার হবে সেখানে আমাকে অতিথি বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ করেছে। যথারীতি আমি পেপার তৈরী করে পাঠিয়ে দিলাম। ইউ এন ডি পি ঢাকাকে অনুরোধ করা হয়েছে আমার যাওয়া আসার সব ব্যবস্থা করতে।
ফলে আমি ইউ এন ডি পি-র ঢাকা অফিসে গেলাম, চিঠি নিলাম। আমার হাতে আছে একদিন। আমাকে মিয়ানমারের বাংলাদেশ এমবাসীতে যেতে হবে ভিসা নিতে হবে।
চিঠি নিয়ে গুলশানে মিয়ানমার এমবাসীতে পৌছাতে দুপুর ১২টা বেজে গেলো। যেয়ে দেখি সেদিনকার মতো ভিসার আবেদন নেয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে।
আমাকে গেট থেকে ঢুকতে দেবে না। আমার কাছে গাড়ী নেই। পরণে তেমন কোন ভালো শাড়ী নেই। দেখলে এমন স্মার্ট মনে হয় না। কাজেই দারোয়ান আমাকে পাত্তা দিলো না।
আমি কি করবো বুঝে পাচ্ছি না। মুখ কাচুমাচু করে দাড়িয়ে থাকলাম। আমার দাঁড়ানো দেখে এক দারোয়ানের মায়া হলো। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো কেন আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তাকে খুলে বললাম।
সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো ইউ এন ডি পি-র চিঠিটা আমার কাছে আছে কি না। আমি বললাম আছে। তিনি দেখতে চাইলেন। আমি দেখালাম। দেখে তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করুন দেখি কি করা যায়।
আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে এক ব্যক্তি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। উক্ত দারোয়ানটি সেই ভদ্রলোকের সাথে কথা বললেন। এরপর আমাকে বললেন, যান আপনি ওনার সাথে কথা বলুন। আমি এগিয়ে যেয়ে তাকে বললাম, আমাকে ইউ এন ডি পি পাঠিয়েছে।
তিনি আমার চিঠি দেখতে চাইলেন। আমি চিঠি দিলাম। চিঠিটা পড়ে সাথে করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমি দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে ডাক এলো।
আমি ভিতরে যেয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ভিসা অফিসার এলেন। তিনি ইউ এন ডি পি-র উপরে খুব রাগ করলেন। এক পর্যায়ে আমাকে বললেন যে আমি টাকা এবং ছবি এনেছি কি না। আমি বললাম, ছবি এনেছি ৪ কপি।
উনি বললেন, ৪ কপি ছবিতে হবে না। আমার মোট ৫ কপি ছবি লাগবে। সাথে ১০০০টাকা লাগবে। আমি বললাম আমার কাছে অত টাকা নেই। তখন উনি বললেন, ঠিক আছে বিকালে ভিসা নেয়ার সময় এসে দিয়ে যাবেন।
এই বলে তিনি আমাকে ভিসা ফরম দিলেন এক কপি। আমাকে করতে হবে ৫ কপি। এমবাসীটি গুলশান ১ ও ২-এর মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। আমি গুলশান ২-এ হেটে গেলাম। কারণ আমার কাছে টাকা নেই।
আমি যেয়ে আবেদন পত্র ফটোকপি করে সাথে অন্যান্য কাগজ পত্রাদি জমা দিয়ে বাসায় এলাম টাকা নিতে। অনেক কষ্ট করে ১০০০ টাকা যোগাড় করে বিকালে আবার এমবাসীতে গেলাম। আমি যখন টাকা দিতে যাচ্ছি তখন ভিসা অফিসারের মুখে হাসি এবং গলায় শ্রদ্ধা মেশানো। আমাকে বললেন, আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আপনি আমাদের রাজকীয় অতিথি।
একটি কাগজ দিয়ে বললেন এই কাগজটি আপনি ইয়াংগুন এয়ারপোর্টে দেবেন। না হলে ঢুকতে দেবে না। আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম।
আমি ৪ দিনের ভিসা পেয়েছি। এই ৪ দিনের জন্য আমাকে গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এর আগে বিদেশে গিয়েছি তখন আমার সাথে অফিসের গাড়ি থেকেছে। সাথে সহযোগিতা করার মানুষ থেকেছে। কাজেই আমি ততটা কষ্ট বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। নিজের এন জি ও ।
গাড়ি কেনা সামর্থ্য হয়নি। স্বামী যশোর অফিসে। আসতে পারলেন না। সহযোগিতা করার মতো বাড়তি মানুষ নেই। তাই সব কাজ একা একা করতে হলো।
যখন এয়ারপোর্টে যেয়ে পৌঁছালাম তখন আমার হাফ ধরে গেছে। খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি করে একটি চিকেন পেস্টি খেতে যেয়ে আমার জিহবা পুড়ে গেলো। খাওয়া দাওয়া সেরে চেক ইন করলাম। ভিতরে যেয়ে দেখি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাশেম ভাই ও কানন ভাবি।
তারা দুজনে ব্যাংকক যাচ্ছেন। অবশ্য আমি থাই এয়ারলাইন্সে করে যাচ্ছি। আরও আছেন এড়াব-এর তত্কালীন পরিচালক শামসুল হুদা সাহেব। এরপর বিমানে উঠলাম। ব্যাংকক থেকে আমি একা হয়ে গেলাম।
বিকালে মিয়ানমারের শেষ ফ্লাইটে আমি যেয়ে পৌছালাম। মিয়ানমার এয়ারপোর্টে আমাকে আবার ধরলো। আমার পাসপোর্টে কোন ডলার এনডোর্স করা নেই। আমি ঢুকতে পারবো না। আমি থাকবো কোথায়, খাবো কি।
যখন ঢাকার এমবাসী থেকে আমাকে যে কাগজটি দিয়েছিল সেটা দেখালাম তখন তারা আমাকে ঢুকতে দিলো। আমি মিয়ানমার এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বের হলাম আর হয়ে গেলাম রাজকীয় অতিথি।
আমাকে ওরা থাকতে দিলো ৭ তারা হোটেলে, হোটেল নিক্কনে। কিন্তু চুক্তি হলো যে রাত্রে আমার নিজের টাকা দিয়ে খেতে হবে। সকালে হোটেল কর্তৃপক্ষ খাওয়াবে।
দুপুরে সেমিনারে খাওয়া হবে। আমার কাছে টাকা নেই। তাই আমি রাত্রে খেলাম না। এমন কি এক কাপ কফিও খাইনি। বাসায় ফোন করে জানাইনি কারণ তাহলে ১ ডলার খরচ হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে হোটেলে খেলাম। যে কয়দিন ছিলাম আমাকে আর নিজের টাকা খরচ করে খেতে হয় নি। সেমিনারটি ছিলো নভেম্বর ১-২ ১৯৯৯ তারিখ। ওখানে ৪দিন খুব ভালো কাটলো। আমার পেপারটি খুবই প্রশংসিত হলো।
এরপর আমি চলে এলাম। ৪দিনের মাথায় যখন বাংলাদেশে পৌঁছালাম তখন আবার আমি সেই সাধারণ মানুষটি। আমাকে বেবি ট্যাক্সী ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলো, আপনি বুঝি গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলেন? আমি তাকে বেশী কিছু বললাম না। শুধু বলালাম, হ্যা ভাই, আমি গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে আপনি কি একটু আমার বাসায় পৌঁছে দেবেন? বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার দয়াপরবশ হয়ে আমাকে বাসায় দিয়ে গেলো।
অবশ্য ভাড়া নিলো। তবে সাধারণের তুলনায় কম। বাসায় ঢুকেই শুনলাম টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে। বিল বাকি পড়েছে। আমি আমার বাচানো টাকা থেকে টেলিফোন বিল পরিশোধ করে আবার লাইনটিকে ঠিক করলাম।
গল্পটা মনে হলো। ভালো লাগলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।