আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্ণী টু চায়না-২০(কুনমিং, রক ফরেস্ট)

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

জার্ণী টু চায়না-২০(কুনমিং, রক ফরেস্ট) প্রায় তিন ঘন্টার এয়ার জার্ণীতে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮ টায় আমরা কুনমিং পৌঁছি। চির-বসন্তের দেশ কুনমিং। এখানকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১৮ ডিগ্রী এবং সর্বনিম্ন মাইনাস ৩/৪ ডিগ্রী বিরাজ করে। এভারেজ তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রী। আজকের কুনমিং এর তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

এখানে সারা বছর পর্যটকদের ভীর লেগেই থাকে। জিনিষ পত্রের দাম অনেক। তবে তুলনামুলক ভাবে বাংলাদেশী খাবার বাংলাদেশ থেকেও সস্তা। ফুলের দেশ কুনমিং। হাল্যান্ডের পর একমাত্র কুনমিং একক ভাবে বেশী ফুল ঊতপাদনকারী দেশ।

এই কুনমিং থেকে চায়নার ব্যাবসায়ীরা ইঊরোপ সহ অন্তত ১৪ টি দেশে ডাইরেক্ট ফুল রপ্তানী করে। যারা কুনিমিং হয়ে চায়না ভ্রমন করেন-তাদের ঢাকা ফেরার সময় বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কুনমিং যাত্রা বিরতী করতেই হয়। কারন কুনমিং থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট প্রতি দিন মাত্র দুইটা। ইস্টার্ণ চায়না এয়ার লাইন্স এর ফ্লাইট কুনমিং থেকে ঢাকা ছেড়ে যায় প্রতি দিন স্থানীয় সময় সকাল দশটায়(চায়নার সাথে বাংলাদেশের সময়য়ের ব্যবধান দুই ঘন্টা। অর্থাৎ আমাদের দেশে যখন সকাল ১০ টা চায়নায় তখন বেলা ১২ টা)।

সদ্য চালু হওয়া চায়না সাউদার্ণ এয়ার লাইন্স এর ফ্লাইট ঢাকা-কুনমিং-গুয়াংজু প্রতি দিন একটা করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে-সেই ফ্লাইট টাইমও সকাল ৯ টার সময়। কাজেই যারা আগের দিন কিম্বা রাতে চায়নার অন্যান্য প্রভিন্স থেকে কুনমিং আসেন-তাদেরকে এখানে "নাইট স্টে" করতেই হয়। তবে অনেক ইয়াং ম্যানই এই সময়টুকু এয়ারপোর্টেই কাটিয়ে দেন। এই এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় কাটানোতে তেমন সমস্যা হয়না। বাংলাদেশীদের থাকা খাওয়ার জন্য এখানে অনেকগুলো বাংলাদেশী রেস্ট/গেস্ট হাঊজ আছে।

এনটিভি এবং প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক মিলে বড় একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে গেস্ট হাঊজ করেছে। নাম দিয়েছে "অবসর বাংলা"। আমি বেশীর ভাগ সময় কুনমিং এই "অবসর বাংলা"য় থাকি। অন্য যারা রেস্ট/গেস্ট হাউজ ব্যবসা করেন তারাও ফ্লাট ভাড়া নিয়ে রেস্ট/গেস্ট হাঊজ ব্যবসা করে। এদের সার্ভিসটাও খুব ভালো।

ওদের অনেক এজেন্ট এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঙ্গালী দেখলেই খুব আন্তরিকতার সাথে দৌড়ে আসে। লাগেজগুলো নিজেরাই তূলে নিয়ে ট্যাক্সিতে তুলবে। নিয়ে যাবে গেস্ট হাঊজে। ২৪ ঘন্টা থাকা খাওয়া,নাস্তা,এয়ারপোর্ট আপ-ডাউন ট্রান্সপোর্ট সহ সিঙ্গেল রুম উইথ এটাস্টড বাথ রুম ভাড়া ১৫০ আরএমবি আর যদি শেয়ার রুম হয় তাহলে নিবে ১০০/১২০ আরএমবি।

ওখানেও কুমিল্লা হোটেল,জালালাবাদ গেস্ট হাউজ এবং বিসমিল্লাহ হোটেল আছে! বাংলাদেশে এমন কোন স্টেশন/শহর/বন্দর/গঞ্জ নেই যেখানে কুমিল্লা হোটেল,বিসমিল্লাহ হোটেল কিম্বা ভাইভাই নামের হোটেল নেই! আমি করাচী,লাহোর,সিঙ্গাপুর,থাইল্যান্ড,দুবাই,জেদ্দা,রিয়াদ,মক্কা-মদীনা শরীফ,কোলকাতা,দিল্লী,আজমীর, বোম্বেতে এমন কি ফ্লোরিডা,নিউইয়র্কেও এই নামের কোন নাকোন হোটেল/ স্টোর/মেস দেখেছি! প্রাকৃতিক বৈচিত্রের প্রদেশ চীনের ইউনান। ইউনান প্রদেশের রাজধানী শহরের নাম কুনমিং। এখানে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা, বরফ ঢাকা পর্বত চুড়া, হিমবাহ, হ্রদ, উষ্ণ প্রসবন, অরণ্য আর বিষুবীয় রেইন ফরেস্ট। চীনের খুব কম প্রদেশেই এমন বৈচিত্রপুর্ন সৌন্দর্য্য আছে। ইউনান সম্পর্কে বলা হয়-এখানে এক পাহাড়েই একসময়ে চার ঋতুর সমাহার ঘটে এবং প্রতি পাঁচ কিলোমিটার পরপর আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা যায়।

কুনমিং' এ নানান রকম দ্রস্টব্য জিনিষ থাকার পরও "স্টোন ফরেস্ট" আর এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। আমাদের ভ্রমন সুচীতে অন্য অনেক কিছু মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান আকর্ষন ছিল "স্টোন ফরেস্ট"। স্টোন ফরেস্ট কে চায়নীজ ভাষায় বলে "ডা লি সি গং ইং"। আমাদের গাইড(গাইডকে চায়নীজ ভাষায় বলে "দাও ইউ") মিজ মেসা ওয়াং'র নেতৃত্বে আমরা যাচ্ছি স্টোন ফরেস্ট। তিনশত বর্গ কিলোমিটার স্টোন ফরেস্ট যেতে আপনাকে দুটো স্তর পার হতে হবে।

স্টোন ফরেস্টের বহির্বিভাগ থেকে শব্ধ হীন, পরিবেশ দুষনমুক্ত ব্যাটারী চালিত হুড তোলা ওয়াগনে (গাড়ি) করে আমরা মোট ১২ জন দর্শনার্থী এগিয়ে চলছি। এখানকার সব গাড়ির ড্রাইভারই(চায়নীজ ভাষায় ড্রাইভারকে বলে "সি টি")স্থানীয় উপজাতি তরুণীরা। যাদেরকে বলা হয় Yi ("ই")। ও দের পড়নে নিজস্ব উপজাতীয় বিশেষ ধরনের রং-বেরঙ্গের পোষাক। মাথায় পাগড়ীর সাথে দুই পাশে লাগানো দুইটা ত্রিশুল জাতীয় শিং।

মেসা জানালো-"শুধু মাত্র অবিবাহিতা মেয়েরাই মাথায় শিং ব্যবহার করে। শিং হলো অবিবাহিতার প্রতীক। কোন পুরুষ যদি তরুনী মেয়েদের বিয়ে করার জন্য পছন্দ করে তাহলে ওই শিং দুটো হবু বরকে ছুঁইয়ে দিতে হবে"। আমি সাথে সাথে মেসাকে মজা করে বললাম-তাহলে আমি ছুঁইয়ে দেই......? মেসা তখন জানায়-"ব্যপারটা ওখানেই শেষ নয়। তারপর তরুণী বিশয়টা তার বাবা-মা কে জানাবে।

বাবা-মা হবু বরের সৌর্য্য বীর্য্য পরীক্ষা করার জন্য তাদেরই বংশের কোন জোয়ান পুরুষের সাথে মল্ল যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তাব দিবে। যদি তুমি যুদ্ধে জয়ী হও তাহলে বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হবে। কিন্তু হেরে গেলে তোমাকে ঐ পরিবারের জন্য বিনে পয়শায় কম পক্ষে ছয়মাস শ্রম দিতে হবে"। একথা শোনার পর আমি আর আগে বাড়িনি...... আমার অবস্থা দেখে মিজ মেসা ওয়াং পিটপিটে চোখ বুজে হাসতে থাকে, ভাবটা যেনো হাঃ হাঃ পঃ গেঃ অবস্থা। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা ঢুকে পরেছি স্টোন ফরেস্টের মুল এলাকায়।

চীনের প্রাচীর সপ্তাশ্চার্য্যের একটি হলেও কুনমিং'র স্টোন ফরেস্টকে পৃথিবীর প্রাকৃতির প্রথমাশ্চর্য বলে গণ্য করা হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে খাড়া কৌণিক পাথরের নানা বিণ্যাস দেখে মনে হয়েটি বুঝি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নানান প্রজাতির ক্যাক্টাসগুলো সব পাথরে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছে! কিম্বা মনে হবে এগুলো পাথরের ক্যাক্টাস অরণ্য। গাইড মেসা জানালো-ভুতত্ববিদদের গবেষণায় জানা গিয়েছে-প্রায় ২৭ কোটি বছর পুর্বে এখানে সমুদ্র ছিল। সেই সমুদ্রের তলদেশে ছিল চুনা পাথরের স্তর। এই স্তর ক্রমাগত উঁচু হতে হতে শিলাস্তরের অভিঘাতে একসময় ছোট ছোট টিলার আকৃতি ধারণ করে।

তারপর পানি, বাতাস আর সুর্য্য তাপে ক্ষয় হতে হতে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে ধীরে ধীরে পাথরগুলো বৃক্ষ এবং ক্যাক্টাসের আকার ধারন করেছে। পাথরাণ্যের একটা অভিন্ন চেহারা থাকলেও কয়েকটা পাথরের আকৃতি রীতিমত বিস্ময়কর! এরকম একটা পাথরের নাম "এশমা"। যার অর্থ সুন্দরী মেয়ে। পাথরটাকে যে কেউ দেখলেই মনে করবে একটি মেয়ের মাথায় রুমাল বাঁধা এবং পিঠে রয়েছে বাঁশের ঝুড়ি। স্থানীয় উপজাতিরা (পুর্বে বর্ণিত আমাদের মেয়ে ড্রাইভার)মনে করে এই এশমা হচ্ছে "ই"(Yi) জাতিগোষ্ঠীর "সানি" গোত্রের একটি মেয়ে......যাকে নিয়ে একটা উপখ্যান(আমাদের দেশীয় আলো মতি-প্রেম কুমার/ বেদের মেয়ে জোসনা টাইপের লোক কাহিনী)আছে-যা বর্ণনা করতে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে।

সেই লোক কাহিনী নিয়ে নাকি "এশমা লাভ স্টোরি" নামক একটি সিনেমা তৈরী হয়েছিল-যা চীনা ভাষা ছারাও ইংলিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, রাশান সহ মোট আটটি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। এরকম নানান আকৃতির বিস্ময়কর পাথরের নানান প্রকৃতি আছে-যা কোনটা দেখতে মা তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে, কোনটা কং, কোনটা ভাল্লুক, কোনটা সিংহ ইত্যাদি। এমনকি একটা দেখতে নাকি মাওসেতুং এর মত! এই স্টোন ফরেস্টের মাঝে কোথাও কোথাও সবুজ চত্তর আছে-যেখানে উপজাতীয় মেয়েরা তাদের নিজস্ব নাচ-গান গেয়ে দর্শকদের আনন্দদানের বিনিময় কিছু বখশিশ পায়। স্থানীয়দের সাথে অনেক বিদেশী ট্যুরিস্টরাও নেচেগেয়ে ফুর্তি করছে। কোথাও কোথাও কিছু জালাধার আছে-যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির রংগীন মাছের বিচরণ দেখে অবাক হবেন।

স্টোন ফরেস্টের মাঝখানে আছে-"ওয়াংফেং প্যাভেলিয়ন" নামের একটা উঁচু টাওয়ার(দেখতে অনেকটা আইফেল টাওয়ারের মত)-যা ১৯৩০ সালে তৈরী করা হয়েছিল। টাওয়ারে ওঠার জন্য আছে ঘুর্ণীয়মান সিড়ি। সেই টাওয়ারে একসাথে ৩০০ জন পর্যটক উঠে দূরবীণ/বায়নোকুলারের মাধ্যমে পুরো স্টোন ফরেস্ট অবজার্ভ করা এবং ছবি তোলার সুযোগ পায়। ওটার উপড়ে উঠলেই দেখা যায় পাথরের বিস্ময়কর বিণ্যাস। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে কত বিচিত্র এবং মনোমুগ্ধকর নান্দনিকতার সৃস্টি হতে পারে তা এই টাওয়ারের উপড় উঠলেই দেখা যায়! এই টাওয়ারের ৩য়, ৪ র্থ তলায় কয়েকটি ফাস্ট ফুডের(জাই কান) দোকান রয়েছে-সেখানে ইংলিশ এবং অরিজিনাল চায়নীজ ফুড পাওয়া যায়।

আমরা সেই টাওয়ারে উঠে অনেক ছবি তুলেছি। আমরা যেমন বিদেশী কিম্বা স্থানীয় উপজাতিয়দের সাথে ছবি তুলতে চাই-আমাদের সাথেও অনেক চীনা এবং ইউরোপীয় পর্যটকরা ছবি তুলেছিল। "ই" রমণীরা পর্যটকদের আমন্ত্রন জানায় তাদের ঐতিয্যবাহী পোষাক পরে তাদের সাথে ছবি তুলতে। অনেকেই তাই করে-যেকোন দেশের পর্যটকরাই উপজাতীয়দের পোষাক পরে-তখন দুর থেকে তাদেকে দেখেও মনে হয়-ওরা যেনো সত্যি সত্যি চায়নীজ উপজাতীয়! স্টোন ফরেস্ট ঘুরে ঘুরে দেখতে আমাদের অন্য কোথাও অন্য কিছু দেখতে যাবার সময় এলো। আমরা বেড়িয়ে এসেছি স্টোন ফরেস্টের বহিরাঙ্গনে।

মিজ মেসা ওয়াং আমাদের সহাস্যে বিদায় জানালেন। আমিও বিদায় জানাচ্ছি পাঠকদের যারা ধৈর্য্য ধরে এতদিন আমার সাথে চায়না ভ্রমনের সাথী হয়েছিলেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।