সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৬
কাল অনেক বলে কয়ে মিজ দুয়োর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম ঐতিহাসিক চায়নীজ হোটেলের চায়নীজ খাবারের হাত থেকে। কিন্তু আজ আর রক্ষা নেই। আজ আমরা খেয়েছি- Beijing Express Restaurant নামক অন্য একটা বিখাত হোটেলে। বেইজিং এর প্রথম সারির ১০ টি রেস্টুরেন্টের মধ্যে এই রেস্টুরেন্ট অন্যতম। এখানকার খাবার বেশ রুচীসম্মত তবে খুব বেশী রকম কস্টলী।
চায়না ভ্রমনে আমি লক্ষ করেছি চায়নীজদের মধ্যে অভক্তিকর কু-খাদ্য (আমাদের কাছে)খাবার একটা প্রচলন। তেমন কিছু খাবারের বিষয় এই পর্বে সামান্য ধারনা দিচ্ছি। সেই অখাদ্য রান্না এবং পরিবেশনের জন্য বেইজিং তথা চায়নাতে অনেক স্পেসালাইজড হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। একদিন জাস্ট দেখার জন্য আমি আর ডেনিয়েল গিয়েছিলাম তেমন একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের নাম-"ব্লু জং"।
উল্যেখ্য যে ঐ সব রেস্টুরেন্টে প্রচন্ড ভীড় থাকে। যার কারনে অনেক আগে থেকেই খাবারের টিবিল বুকিং দিতে হয়। এই হোটেলে সেইসব বজ্জাতী খাবারের মধ্যে একটা খাবার আমাদের দেশ থেকে আমদানীকৃত। কোরবানীর সময় এবং নিয়মিত কশাইর দোকানে ফেলে দেয়া গরু-ছাগল এবং মহিষের পেনিস এবং অন্ডকোষ। এগুলো পরিস্কার করে হিমায়িত এবং ড্রাই(শুটকী) করে বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, সিংগাপুর, চীন এবং কোরিয়াতে রপ্তানী করা হয়-যা আমি আগে জানতামনা।
যদিও আমি ওগুলোর ছবি তুলে নিয়ে এসেছি কিন্তু এখানে সেই ছবিগুলো এড করা রুচীসম্মত হবেনা। সে হোটেলে বড় করে নিয়ন সাইনে লেখা আছে-(আমি বাংলায় তরজমা করে লিখছি)-"এখানে ৩০ প্রকার এনিমেল পেনিস পাওয়া যায়"! বড় বড় পোস্টারে সেই সবের রান্না করা ছবি এবং খাবারের উপকারিতা বর্ণনা করা আছে। একটার বিশয়ে লেখা আছ-(আমি বাংলায় তরজমা করে লিখছি)"ইহা খাইলে মেয়েদের ত্বক এর কমনীয়তা বাড়ে... এবং পুরুষে খাইলে......। "(জিনিষটির নাম ডগ পেনিস)-সহ আরো অনেক গুনাগুন। আমি ডেনিয়েলকে খোঁচা মেরে বললাম-যাক তাহলে আমাদের দেশের ফেলনা জিনিষ খেয়ে তোমাদের মেয়েদের ত্বক এত সুন্দর হয়েছে!
গতকাল সময়াভাবে আমরা যে সব বিখ্যাত যায়গা দেখতে পারিনি আজ সেই সব যায়গায় বেড়াতে যাই।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মিং টম্ব। মিং টম্ব ফরবিডেন সিটির পাশেই। মিং টম্ব হচ্ছে প্রাচীন চায়নীজ রাজা রানীদের কবরস্থান। রাজা-রানীরা মরে যাবার পর কিন্তু আমাদের মতই "পাবলিক" হয়ে যায়! আলাদা বলতে শুধু ওদের কবরের স্থাপত্য নিশানা। আমার কাছে কবরস্থান কোন কালেই ভাল লাগেনা।
তাই আমি ঐ যায়গায় বেশী সময় থাকিনি। বাংলাদেশী কবরস্থানে কিন্তু প্রেম করে মজা। কারন, ওখানে সহজে কেউ যায়না। অনেক নিরিবিলি, ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা ওখানে অনেক কম থাকে। আমার মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু প্রেমিক যুগল এখানেও দেখেছি।
তিয়েনএনমেন স্কয়ার কম্পাউন্ডেই আর একটা দেখার মত যায়গা হলো-China National Museum। এটা স্কয়ারের ঠিক পুর্ব দিকে অবস্থিত। এই মিউজিয়াম তৈরী করা হয়েছে Chinese History Museum এবং Chinese Revolutionary Museum কম্বিনেশনে। এই মিউজিয়ামে সুপ্রাচীণ চায়নীজ ইতিহাস থেকে বর্তমান উন্নত চায়নার ধারাবাহিক নিদর্শন আছে। এখানে আছে প্রচুর পরিমানে ভাস্কর্য্য, মুরাল, সুভ্যেনির, ছবি এবং বইপুস্তক।
আসলে এই মিউজিয়াম দেখার জন্যই শুধু মাত্র ২/১ দিনের প্রগ্রাম নেয়া দরকার। তানাহলে এর বিশালতা দেখে তৃষনা মিটবেনা। মিউজিয়াম দেখতে দেখতে হঠাত দেখি একটা পাথরের তৈরী এক যোদ্ধার আবক্ষ ভাষ্কর্য্য। দেখতে মুসলিম মুসলিম চেহারা। আমি ভেবেছিলাম কোন মোঘল সম্রাটের মুর্তি।
প্রথমে চায়নীজ ভাষায় এবং নীচে ইংলিশে লেখা আছে- TOIMUR LOUNG আমি থেমে গেলাম এই নাম দেখে। তাঁর পরিচিতি দেয়া আছে এভাবেঃ-Date of birth:6th April,1336, Date of Expire: 18th February 1405, Date of Palace: Shahrisab, Transe Oxianna, fathers name : Taraghi, mothers name: Tekina Mahbegum সংক্ষিপ্ত ভাবে আরো লেখা আছে(আমি বাংলায় তরজমা করে লিখছি)ঃ- বিশ্ববিজয়ী বীর তৈমুর লং তৈমুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল-পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে। তাঁর শাসন আমল স্থায়িত্ব কাল ১৩৭০ হইতে ১৪০৫ সাল। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, কাজাখস্থান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কেমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, সমগ্র ভারয়ীয় উপমহাদেশ থেকে চীনের কাশগড় পর্যন্ত তাঁর শাসনাধীন সাম্রাজ্য ছিল।
তিনি অত্যন্ত ভয়ংকর এবং নির্মম প্রকৃতির যোদ্ধা ছিলেন। তার দস্যুতা থেকে নারী এবং শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পেতনা। তৈমুর লং'র আক্রমন থেকে রক্ষা পেতেই প্রাচীণ চীনের হেবাই অংশে গ্রেট ওয়াল তৈরী হয়েছিল।
আমার খুব ভালো লেগেছে এই মিউজিয়ামে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি ইকবালের ভাষ্কর্য্য দেখে। এনারা যখন চায়না ভ্রমন করেছিলেন-সেই দিন তারিখ উল্ল্যেখ করে কিছু বিবরণ লেখা আছে।
চায়না ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখার পর আমরা যাই "সামার প্যালেস" দেখতে। সামার প্যালেসের দুরত্ব তিয়েনএনমেন স্কয়ার থেকে দশ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিম দিকে। সামার প্যালেস হল-প্রাচীন মিং রাজাদের গ্রীষ্মকালীন রাজপ্রাসাদ এবং ইম্পেরিয়াল গার্ডেন। গ্রীষ্মকালে তখনকার রাজ পরিবার এখানে সময় কাটাতে যেতেন। ন্যাচারাল বিউটি মানুষের সৌন্দর্য্য সৃস্টির সমন্বয়ে অপুর্ব এক সৌন্দর্য্যের প্রতীক এই সামার প্যালেস।
যা বর্তমানে পাব্লিক পার্ক। রাজপ্রাসাদ এবং বাগান মিলিয়ে প্রায় ৩০০ হেক্টর জায়গার উপড় নির্মিত এই প্যালেস। প্যালেসটা কয়েক ভাবে বিভক্ত। মুল ভবনটি একটা উঁচু পাহাড়ের উপর নির্মিত। ভবনের চারিদিকে লেক।
লেকের নাম কুনমিং লেক। চায়নাতে কুনমিং নামে একটা প্রদেশ আছে-যেখানে চির বসন্ত বিরাজমান। কুনমিং বাংলাদেশ থেকে খুব কাছে। ২ ঘন্টার এয়ার জার্ণী। যারা চায়না ভিজিট করতে চান-তারা যদি কুনমিং হয়ে মেইন চায়নায় আসেন তাহলে সময় এবং খরচ উভয় অনেক সাশ্রয় হবে।
ঢাকা-কুনমিং ফ্লাইট চালু হবার পুর্বে আমরা ঢাকা-হংকং রুটে চায়না ভ্রমন করতাম। এখন বেশীর ভাগ যাত্রী ঢাকা-কুনমিং রুটে ভ্রমন করে সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ের জন্য। তাছারা কুনমিং চীনের অন্যতম পর্যটন শহর। সামার প্যালেসের লেকের নাম কেন "কুনমিং লেক" তা কাউকে জিজ্ঞেশ করেও জানতে পারিনি। আমার ধারনা কুনমিং'র সৌন্দর্য্যের সাথে তুলনা করার কারনেই সামার প্যালেস লেকের নাম কুনমিং লেক রাখা হয়েছে।
সামার প্যালেস মুল ভবন লেকের ভিতর একটা কৃতিম দ্বীপের উপড়। যা ১৭৫০ সনে মিং রাজা তৈরী করেছিলেন। এই ভবনের সামনেই ৫০ মিটার উঁচু একটি ব্রঞ্জ নির্মিত সিংহ, অনেক গুলো ব্রঞ্জ নির্মিত ষাড় এবং বিশাল বিশাল পাথড় কেটে বিভিন্ন প্রানীর ভাষকর্য্য আছে-যা দর্শকদের মন কাড়ে। এই ভবনের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্ব আছে ভারতের উদয় পুর রাজা মানসিংহের প্রাসাদের। কিন্তু সৌন্দর্যের দিক থেকে উদয়পুর রাজপ্রাসাদ অত্যন্ত ম্লাণময় সামার প্যালেসের কাছে।
কিছু কিছু সৌন্দর্য্য আছে যা বর্ণনাতীত। সামার প্যালেসের সৌন্দর্য্য ঠীক তেমনই-চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্য্য সত্যি প্রকাশ করা যাবেনা। ১৯৯৮ সনে UNESCO's World Heritage লিস্টেড হয়েছে। চায়নীজরা সামার প্যালেসকে বলে "ইয়েহাই হুয়ান" যার অর্থ হতে পারে স্বর্গের বাগান কিম্বা হতে পারে Garden of Nurtured Harmony in Chinese.
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।