আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৪

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৪ রাতে ঘুমনোর পুর্বে শুরু হয় অদ্ভুত রকমের এক সমস্যা। চায়নার বড় বড় সব হোটেলেই(যে সব হোটেলে বিদেশীরা থাকে) "মাসাসী" ওয়ালীদের প্রচন্ড রকমের উতপাত। রাত ১২/১টা পর্যন্ত বিভিন্ন জন রুমে ফোন করে শুধু বলবে-"দু ইউ নিদ মাসাসী"? (ডু ইউ নিড মাসাসী?) "ওয়ান তাইম ফাইভ হান্দেত রেন মেন বিন" (ওয়ান টাইম ফাইভ হান্ড্রেড RMB)। আমার ছেলে একা এক রুমে ঘুমোবে। সে অত্যন্ত কৌতুহলী ছেলে।

সব কিছুতেই তার অসীম কৌতুহল! মাসাসীরা ওকে ফোন করলে কি অবস্থা হবে ভেবে আমি এবং ডেনিয়েল খুব চিন্তিত। অবশেষে ডেনিয়েল বিশয়টা হোটেল কর্তিপক্ষকে বলে একটা উপায় বের করলো-সাজিদের অজান্তে ওর রুমে রাতে আমার রুম ছাড়া সকল ইনকামিং কল বন্ধ থাকবে। পাশের রুমে আমার সাথে যোগাযোগের জন্যই শুধু আউট গোয়িং কল সার্ভিস থাকবে। রাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল আজ আমরা গ্রেট ওয়াল দেখতে যাব। কিন্তু বাধ সেধেছে-প্রচন্ড শীত।

কারন আমাদের সাথের শীতের পোষাক গ্রেট ওয়াল দেখতে যাবার জন্য যথেষ্ঠ উপযোগী নয়। রাতেই ডেনিয়েল আমাদের বাপ-বেটার জন্য পশমী লং কোট(চায়নীজরা বলে গ্রেট কোট) ভাড়া নিয়েছে-দোকান থেকে। যাদেখতে অনেকটা আমাদের দেশীয় মোটা লেপের মত। প্রতিটা লং কোটের দাম নাকি ৮০০ থেকে ১২ শ ডলার। তাই মাত্র ৪/৫ দিনের জন্য লং কোট নাকিনে দোকান থেকেই ভাড়া নেয়া যায়-প্রতি দিন ৮/১০ ডলার ভাড়ায়।

এই কোট যেহেতু ঢিলেঢালা-তাই সাইজ কোন ফ্যাক্টর হয়না। তাছাড়া আমরা বাপ-বেটা লম্বায় সমান। চীনে আমরা সকালে নাশ্তা করি হোটেল রুমেই(কম্পলিমেন্টারি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট)কিন্তু সেই ইংলিশ নাশ্তা খেয়ে আমার তৃপ্তি হয়না। দীর্ঘ ২০/২২ বছরে কোন চায়নীজ আমাকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বলেনি। হোটেলের ব্রেকফাস্ট খুব কস্টলি।

তাই আমি বেশিরভাগ সময় হোটেল থেকে ফ্রী দেয়া ফ্রিজের চা-বিস্কুট, ফ্রুটস খেয়েই কাটিয়ে দেই। এবার বুদ্ধি করে একটা শপিং মল থেকে এক ডজন ডিম কিনে নিয়ে এসেছি। সাজিদ সকালে আমার রুমে আসে নাশতা খেতে। হোটেল রুমে চা বানাবার জন্য ইলেক্ট্রিক কেটলীতে ডিম সিদ্ধ করে খেয়ে নেই। সাথে চা-বিস্কুট-চকোলেট, ফ্রুটসতো থাকেই।

ঠিক দশটার সময় ডেনিয়েল কল করে বলল-"জাও শাং হাও"(Good morning!). "ওয়ান শাং সি ডিয়ান"(এখোন বেলা দশটা) তোমরা কি যাবার জন্য রেডি"? আমরা আগে থেকেই রেডি ছিলাম। আমরা চলছি গ্রেট ওয়াল দেখতে। আমাদের জন্য কোম্পানীর সার্বক্ষিণিক গাড়ী(মাইক্রোবাস) আছে ড্রাইভার সহ। বেইজিং থেকে গ্রেট ওয়াল চারটা স্পট থেকে ঢোকা যায়-যেগুলো হচ্ছে-মেইন সিটি থেকে ৪১ কিঃমিঃ দূরে পাটালী, ৭০ কিঃমিঃ দূরে বাদালিং, ৯০ কিঃমিঃ দূরে মুটিয়ানাইড এবং ১১০ কিঃমিঃ দুরের সিমাটাই। আমরা যে স্পট থেকে ঢুকবো সেই যায়গার নাম পাটালী।

বেইজিং শহর থেকে দুরত্ব ৪১ কিঃমিঃ পাটালী পৌঁছতে আমাদের সময় লাগে ৩০ মিনিট। প্রতিটা এডাল্ট টিকেট ৫০ RMB(Yuan) এবং ১২ বছরের বাচ্চাদের প্রবেশ টিকেট মুল্য ১০ RMB. চায়নীজ মুদ্রার অফিসিয়াল নাম যদিও ইউয়ান, কিন্তু ওরা সবাই ওদের সব ধরনের টাকাকেই RMB(রেন মেন বিন) বলে। আট RMB সমান এক ইউএস ডলার। আমি মনে করি টিকেট মুল্য যথার্থ। কারন এই টাকা দিয়েই গ্রেট ওয়ালের মেন্টেনেন্স সহ যাবতীয় খরচ ব্যয় করা হয়।

আমাদের দেশের আহসান মঞ্জিলের প্রবেশ ফি মাত্র ২ টাকা! সেই কারনেই ওখানে ময়লার ডিপো, গাঁজা খোর আর ভেগাবন্ডদের আড্ডাস্থল। যদি ওখানকার প্রবেশ ফি ৫০ টাকা হত-তাহলে ওখানকার রক্ষনাবেক্ষণ অনেক সুন্দর ভাবে করা যেত। আমরা টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকতেই একদল টিন এজ মেয়ে "হুয়ান জিং" (ওয়েল কাম) জানালো। তারা মুলত বিভিন্ন কলেজ/ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট। ছুটিকালীন সময়ে "ডাও ইউ"(গাইড) হিসেবে কিছু উপার্যন করতে চায়-সেই সংগে আবার অনেকেই প্রথম গ্রেট ওয়াল দেখার স্বাদ নিচ্ছে।

আমরা পৌঁছেগিয়েছি গ্রেট ওয়াল। প্রচন্ড শীত! ভাড়া করা লং কোটও আমাদের শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা করতে পারছেনা! আজকের তাপমাত্রা মাইনাচ ৮ ডিগ্রী। রাতের এই তাপমাত্রা ছিল মাইনাচ ১২ ডিগ্রী। আমি ডেনিয়েলকে জানতে চাই-নো মে ওয়ান সেং নে(বেশী শীতের সময় কত ঠান্ডা পরে?) ডেনিয়েল জানালেন-"ওয়ান সেং ইউ সি হুয়ি জিয়াং ডাও লিং জিয়া এর সি সে সি ডু"(শীত কালে রাতে তাপমাত্রা সচারচর মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেঃ)। গ্রেট ওয়াল এলাকায় শহর এলাকা থেকে অনেক শীত বেশী।

কনকনে শীতল বাতাস সুঁচের মত নাকে কানে ঢুকে যাচ্ছে! চোখের পাপড়ীতে তুষার জমে যাচ্ছে! কিছুক্ষণের ভিতরেই পা দুটো যেনো ভারী হয়ে চলত শক্তি হারিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে-আমার দু'পায়ে দুর্ধর্ষ আসামীর মত লোহার ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে দেয়া হয়েছে! শীতে আমার পা আর চলছেনা। নিজের ঠোট কামড় দিয়ে বোঝার উপায় নেই আমার মুখের সাথে ঠোট আছে কি নেই! হ্যান্ড গ্লাভস পরেছি-তাতেও কোন লাভ হচ্ছেনা। ডেনিয়েলের মাথার মাংকি টুপি খুলে সাজিদকে দিয়েছে। আমার গাল অবশ হয়ে আছে।

গ্রেট ওয়ালের চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কোথাও কোথাও সম্পুর্ণ গ্রেট ওয়াল বরফে ঢেকে আছে। সাজিদ আর ডেনিয়েলের ছেলে প্রথম অবস্থায় খুব উতসাহের সাথে দৌড়াদৌরি করলেও এখন প্রচন্ড শীতে ঝিমিয়ে পরেছে! মাঝে মাঝে রোদের দেখা মিললেও তা এমন শীতের জন্য যথার্থ নয়। বরং মনে হচ্ছে-সুর্যটাও যেনো শীত ছড়াচ্ছে! আমরা হেটে হেটে অনেক দূর চলে যাচ্ছি। এখন আমাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে ডেনিয়েলের ছেলে এবং আমার ছেলে।

বিশেষ করে আমার ছেলে খুব কাবু হয়ে পরেছে শীত এবং হেটে চলার কস্টে। ডেনিয়েলরা শীতে অভ্যস্ত এবং ওরা দেখতে কিছুটা ছোট খাট হলেও ওদের ফিজিকাল ফিটনেস তথা স্টামিনা আমাদের চাইতে বহুগুন বেশী। ডেনিয়েলের বৌ'র মোটেই ক্লান্তি নেই। আমি অসুস্থ্য হলেও কস্ট করে নিজেকে ঠিক রাখার প্রানন্তকর চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছি! সাজিদের চোখের পাপড়ী পর্যন্ত তুষারে সাদা হয়ে গিয়েছে। মোটা লং কোটও তুষারে সাদা হয়েগিয়েছে।

আমাদেরকে দেখতে শান্তাক্লজের মত লাগছে! আমাদের দলের সাজিদ ছারা সবাই আগেও গ্রেট ওয়াল দেখেছি। গ্রেট ওয়াল তৈরী হয় Qin, Han এবং Ming রাজাদের আমলে। বহিঃশত্রুর আক্রমন ঠেকাতেই এই গ্রেট ওয়াল তৈরী শুরু হয়েছিল প্রথম ১৩৬৮ সনে। অনেক সৈন্য, জেলবন্ধী, স্থানীয় জনগনের প্রায় ২০০ বছরের পরিশ্রমের ফসল এই গ্রেট ওয়াল নির্মাণ সমাপ্ত হয় ১৬৪৪ সনে। বেইজিং’র পুর্ব দিকের Shanghaiguan, Jiayuuan, Hebei, Beijing, Tianjing, Shanjhai, gangchu, Ningjhia, Shanx প্রভৃতি প্রদেশ সীমান্ত এলাকা পার হয়ে প্রায় ১০,০০০ কিঃ মিঃ গ্রেট ওয়াল নির্মান করা হয়েছিল।

কিন্তু বর্তমানে ৬,৭০০ কিঃ মিঃ অর্থাৎ ৪,১৬৩ মাইল এলাকা জুড়ে গ্রেট ওয়াল মোটামুটি অক্ষত আছে। ১৯৮৭ সনে UNESCO কর্তিক গ্রেটওয়াল World Heritage ঘোষনা করার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে প্রতি দিন গড়ে ৬০ হাজার পর্যটক গ্রেট ওয়াল ভিজিট করে। পর্যটকদের কাছ থেকে প্রবেশ ফি এবং সুভেনির বিক্রি বাবদ চায়না সরকার প্রতি বছর ২০০০ কোটি ইউয়ান আয় করে থাকে। আমরা অনেক ছবি তুলেছি গ্রেট ওয়ালের, ছবি তুলেছি অনেক ভিন দেশীদের ফুর্তি করার, হৈহুল্লোর করার দৃশ্যের।

৩/৪ মাইল পর পর গ্রেট ওয়ালের পাদদেশে কিছু ভিজিটরস রেস্ট রুম, ওয়াশ এন্ড ক্লিনিং রুম(W & C) আছে। অনেক হাটার পর বেলা ১ টার দিকে একটা W & C আমরা গড়ম পানিতে একটু ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি এবং সাথে করে নেয়া খাবার খেয়ে নিচ্ছি। W & C এ মদ, বিয়ার, ড্রাই ফুড ছারাও গ্রেট ওয়াল সংক্রান্ত অনেক বই, সুভ্যনির, ম্যাপ ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। এসব যায়গায় প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারও আছে। বেশ কয়েকটা যায়গায় কিছু চায়নীজ তরুন-তরুনী মজা করে বিদেশীদের কাছে ১০ আর এম বি দামে গ্রেট ওয়াল ভিজিটের "সার্টিফিকেট" ইস্যু করছে! অনেকেই সেই সার্টিফিকেট নিতে হুমড়ী খেয়ে ভীড় করছে! যারা প্রথম গ্রেট ওয়াল দেখতে যাবেন তাদের জন্য কিছু জরুরী টিপসঃ-শীতের সময় গ্রেট ওয়াল দেখতে চাইলে খুব ভারী শীতের কাপড় অবশ্যই সাথে নিবেন।

কিছু খাবার সাথে নিবেন। কারন ওখানে যেসব খাবার দোকান আছে-তা গলা কাটা দাম নিবে। বৃস্টির মত তুষারপাত থেকে ভিজে নাযাবার জন্য সাথে ছাতা নিবেন। রেইন কোট নিলে খুব ভালো হয়। জাংগল কেডস পায়ে দিয়ে গেলে হাটতে সুবিধা হবে।

মাথা, মুখ ঢেকে রাখার জন্য মাংকি ক্যাপ খুব ভাল কাজে দিবে। পানি খুব কম খাবেন। কারন ওয়াশ এন্ড ক্লিন রুম কয়েক মাইল পর পর। সেগুলো ব্যবহারের জন্যও পয়সা গুনতে হবে। দলবদ্ধ হয়ে চলাচল করবেন।

অবশ্যই সাথে ক্যামেরা নিবেন গ্রেট ওয়ালের সৃতি ধরে রাখার জন্য। আমরা বিকেল ৫ টায় বেইজিং শহরে ফিরি। মিজ দুয়ো আমাদের নিয়ে কালকের মত বেইজিং'র অন্য আর একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে(Beijing Orient Restaurant) ডিনার করতে যেতে চাইলে আমিই বললাম-আজ আমরা কেএফসি তে হালকা কিছু খাব। তোমাদের বড় রেস্টুরেন্টে খাবনা। মিজ দুয়ো বললেন-"না তাহয়না।

কেএফসি'তে তোমাদের খাওয়ালে ডুয়াং সি জাং(ম্যানেজিং ডাইরেক্টর) মিজ ফেং মাইন্ড করবেন। আজ তোমরা অনেক কস্ট করেছো-কাজেই তোমাদের হেভী ডিনার করা উচিত"! ডেনিয়েল আমাদের সমস্যাটা বুঝে আমাদের নিয়ে একটা কেএফসি রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।