আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্ণী টু চায়নাঃ(হংকং)-৮

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

জার্ণী টু চায়নাঃ(হংকং)-৮ হংকং এর রাস্তায় চলাফেরা বলতে গেলে অনেকটাই আমাদের দেশের মত। অর্থাত, ট্রাফিক সিগনাল নিয়ে তেমন কড়াকড়ি নেই। যদিও ট্রাফিক সিগনাল আছে-কিন্তু সুযোগমত ফাঁকফোকর গলিয়ে ইচ্ছেমত রাস্তা পার হওয়া সম্ভব। এখানে সিংগাপুরের মত সব কিছুতেই কঠোর আইন নেই রাস্তা পারাপারে কিম্বা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায়। এমন অনিয়মের পরিবেশেই যেহেতু জীবনের অর্ধশত বছর পার করছি-তাতে আমার মত মানুষের খুশী হবারই কথা! কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে(ভারত-পাকিস্তান বাদে)বেশীরভাগ দেশেই আমরাও "সাইজ" হয়ে চলাচল করি সেবিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই।

ঐযে দূরে দেখা যাচ্ছে লালবাগ মসজিদের মিনারের মত উঁচু চুড়া। অনেক দূর থেকেই পড়া যাচ্ছে "কাউলুন মস্ক এন্ড ইসলামিক সেন্টার"। নীচে আরবীতেও লেখা আছে "মসজিদুন কাউলুন"। চমতকার মনোমুগ্ধকর ডিজাইনে কারুকাজ খচিত এমন সুন্দর একটা মসজিদ কাউলুনে দেখতে পাবো ভাবিনি। হংকংবাসীর প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ।

পাশাপাশি এখানে হিন্দু, ইসলাম, খ্রীস্টান, কনফুসিয়ান এবং তাউ ধর্মের লোকের বসবাস এই ঘনবসতিপুর্ণ নগরীতে। বর্তমানে এখানে প্রায় ১২ লক্ষ খ্রীস্টান, ১ লক্ষ কুড়ি হাজার মুসলিম, ২২ হাজার হিন্দু, ২ হাজার ইহুদী এবং ২ হাজারের বেশী শিখ ধর্মাম্বলী বাস করে এবং বাকী সবাই বৌদ্ধধর্মাম্বলী(তথ্য সুত্র হংকং ট্যুরিজম সেন্টার)। ধর্ম নিয়ে এখানে কারো কোন বাড়াবারি নেই। যেযার ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমি এই মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করলাম।

নামাজ পড়ে বের হতেই একজন স্মার্ট, মাস্টার্স ডিগ্রী ভিক্ষুকের দেখা পেলাম-তিনিও আমাদের দেশী। আলাপান্তে জানতে পারি-বিক্রমপুরের ছেলে--- জাপান যাবার জন্য এক দালালকে ১৮ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। জাপান যাওয়া সম্ভব হয়নি। সব কিছু হারিয়ে এখন স্থানীয় বাংলাদেশীদের দয়ায় এবং ভিক্ষায় জীবন যাপন করছেন। আর কোন দিন দেশে ফিরে যাবেননা-যদি টাকা পয়সা কিছু নাকামাতে পারেন।

নামাজ শেষে হেটে হেটে যাচ্ছি মসজিদের বাম দিকে কাউলুন পার্কে। আমার সাথে সেই ভাগ্যাহত যুবক। খুব সাজানো গোছানো পার্কের ভিতর আছে ছোট ছোট লেক। লেকের ভিতর বৃহদাকার পেলিক্যান, রাজহাঁস সহ অনেক নাম নাজানা পাখি বিচরণ করছে। বিশাল মেটাল নেটের ভিতর নানান জাতের পাখিদের বন্দী করে রাখা হয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য।

শিল্পায়নের যুগে বনের মুক্ত পাখিদের প্রাকৃতিক আবাসন ধংশ করেও মানুষ ক্ষান্ত হয়নি। এখন সেই বুনো পাখিদের লোহার খাচায় বন্দী রেখে সভ্য মানুষদের চিত্তবিনোদনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। নিঃশেষ হয়ে যাওয়া প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাঁচাবন্দী করা হচ্ছে। ভাগ্যাহত যুবক আমার পিছু নিয়েছে-আমার আস্কারা পেয়েই। আমি শুনছি তাঁর কস্টের কথা, তার স্বপ্ন ভঙ্গের করুণ কাহিনী।

আমার ছেলে এবং মিজ সুকসুকো'র ডাকে চলে যাই টেম্পল স্ট্রীট এলাকায়। টেম্পল স্ট্রীট পুরনো হংকং এলাকায় অবস্থিত। এই এলাকার একটা আলাদা ঐতিয্য আছে। যেমন আছে আমাদের পুরনো ঢাকার ওয়ারী, গেন্ডারিয়া এলাকার। বাড়ীঘর অনেক পুরনো হওয়ায় চারিদিক দেখতে কিছুটা অপরিচ্ছন্ন মনে হলেও অপরিস্কার নয় মোটেই।

এই এলাকাটা মুলত ১০০ ভাগ চায়নীজদের বসতি। আমাদের ঢাকায় যেমন শস্তা দামে পণ্য কেনার জন্য বংগবাজার আছে-ঠিক তেমনই একটা এলাকায় হলো এই টেম্পল স্ট্রীট। আমরা অনেকেই জানি-হংকং ইলেক্ট্রিনিক্স পণ্যের জন্য বিখ্যাত এবং অনেক দেশের তুলনায় বেশী শস্তা। কথাটা কিছু সত্য, অনেকটাই মিথ্যা। এখানেই কিছু কিছু জিনিষের দাম অত্যন্ত শস্তা।

তবে তা সম্পুর্ণ দড়াদরি করে কিনতে পারলেই শস্তা। দড়াদরি নাকরে কিনলে পস্তাতে হবে। এখানে এই শস্তা বাজার বসে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত। আমার ছেলে ঢাকাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাকে একটা প্লে স্টেশন-৩(PS-3) কিনে দিতে হবে। আমরা বেশ কয়েকটা ইলেক্ট্রনিক্স পাণ্যের দোকানে প্লে স্টেশন সেট দেখি।

দাম জানতে চাই। দাম জিজ্ঞেস করলে ক্রেতা যদি পালটা কোন দাম নাবলে তাহলে আমাদের দেশের বংগবাজার কিম্বা ফুটপাথের দোকানীদের মত বাজে মন্তব্য শুন্তেই হবে। এবং পণ্য কেনানোর জন্য দোকানের সামনে দাঁড়ানো সহকারিরা ক্রেতার পিছনে পিছনে দৌড়ে আসবে। প্রতিটা দোকানে সাইনবোর্ডে ইংলিশ এবং চায়না ভাষায় লেখা আছে- "অল দ্যা প্রাইস আর ফিক্সড, নো বার্গেইনিং"(সু ইউ জিয়াঞ্জি দাউসি গুডিয়াংডি, বু নেং)। আমি দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানী বললো-ফিক্সড প্রাইস ২৫০০ ডলার(ইউ এস ডলার), নো বার্গেইন।

পাঠক, আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে-হংকং এ তিন ধরনের কারেন্সী বৈধভাবে চলছে। এখানে হংকং ডলার, ইউ এস ডলার এবং চায়নীজ ইউয়ান(আর এম বি)সমান ভাবেই চলে। আগেই বলছে ফিক্সড প্রাইস, তারপরও দাম আমাকে বলতেই হবে-তানাহলে ওদের দাঁত খিচুনী দেখতে হবে। আমি বললাম-আমার কাছে মাত্র ৩০ ডলার আছে। আজ কেনা সম্ভব হবেনা-কাল বেশী টাকা নিয়ে আসবো তখন কেনা যাবে।

আমার উদ্দ্যেশ্য হলো আরো কয়েকটি দোকানে দাম যাচাই করা এবং বেইজিং/সাংহাই'এ কত দাম তা টেলিফোনে জেনে নেয়া। কিন্তু উপায় নেই-দোকানী আমাদের পিছনে আটার মত লেগে আছে। দোকানী বললো-অসুবিধা নেই-আমরা তোমার সাথে তোমার হোটেলে যাচ্ছি। তুমি মাল নিয়ে নাও হোটেল থেকেই আমরা টাকা নিয়ে নেবো! আমরা নানান বাহানায় ওখান থেকে চলে আসার ফন্দি আটছি-কিন্তু আমাদের ফন্দি কাজে লাগছেনা। আমি দাম বললাম ৩০০ ডলার।

তখন আমাদেরকে চায়নীজ ভাষায় খুব সম্ভবত গালাগালি করে! এখানে কিন্তু মিজ সুকসুক আমাদের কোন হেল্প করছেনা! তার কথা হলো- "আমি তোমাদের দোকানে নিয়ে এসেছি তোমরা দড়দাম করে কেনো, আমার হস্তক্ষেপ করা চল্বেনা"! তখন আমার মনে হচ্ছিল সুকসুক আমাদের সাথে থাকলেও সে দোকানীদের দলে। আমার ছেলে বললো-আব্বু, আমরা অবশ্যই দাম নিয়ে বার্গেনিং করবো। ওরা আমাদের কি ভাবলো তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসেনা। এখানেতো আমাদের কেউ চিনেনা। আমার ভাবনাটাও তেমনই।

অনেক দোকান ঘুরে একটা দোকান থেকে পি এস-৩ কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও দাম ২৫০০ ডলার এবং ফিক্সড প্রাইস। আমি ভয় আর লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দাম বলি-৫০০ ডলার। দোকানী প্রথমে খুব বিরক্ত হয়ে বললো-আমরা নাকেনার জন্যই এমন অবাস্তব দাম বলছি। মহিলা দোকানী খুব আক্ষেপ করে বললো-এমন সুন্দর জিনিষ্টার দাম মাত্র ৫০০ ডলার বলতে তোমার খারাপ লাগলোনা? ঠিক আছে তোমার ছেলের যেহেতু পছন্দ হয়েছে তাই ছেলের সৌযন্যে ২০০০ ডলার দিও।

এই দোকানেও কিন্তু নিয়ন লাইটের আলোতে লেখা আছে ফিক্সড প্রাইস শপ "অল দ্যা প্রাইস আর ফিক্সড, নো বার্গেইনিং"(সু ইউ জিয়াঞ্জি দাউসি গুডিয়াংডি, বু নেং)। শেষ পর্যন্ত অনেক দড়াদরি করে ৬০০ ডলারে পি এস-৩ কিনতে সক্ষম হই। বেইজিং, সিংগাপুর ওটার দাম কমপক্ষে ৮০০ ইউ এস ডলার। আমি জানিনা-কি ভাবে ওরা এমন শস্তায় বিক্রি করে! পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।