সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
জার্ণী টু চায়নাঃ(হংকং) - ৬
আমরা অপেক্ষা করছি ডিনারের জন্য, খালি টেবিলের জন্য। এখানেও লাইনের ব্যাপার! আমাদের সিরিয়াল ১৮ নম্বর। আমরা যখন অপেক্ষা করছি তখন আমার ফুটবল পাগল ছেলে টিভিতে ইংলিশ ফুটবলে মজেছে(এই সব পাব্লিক প্লেসের টিভিতে সাউন্ড মিউট করা থাকে)। একা একাই নিবিস্টমনে খেলা দেখার সাথে সাথে মনের অজান্তে ধারা ভাষ্য দিচ্ছে-যা ফুটবল খেলা দেখার সময় ওর সব সময়ের অভ্যাস। ওর ধারা ভাষ্য দেখে অপেক্ষমান অনেকেই টিভি দেখা বাদ দিয়ে ওকে দেখছে! এখানে বলে রাখছি-আমার ছেলে ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ফুটবলের ধারা ভাষ্যকার(কমেন্টেটর) হতে চায়।
একবিংশ শতাব্ধীতে এমন "এইম ইন লাইফ"(ইচ্ছার) কথা আমি জীবনে আর কোন আধুনিক তরুণের কাছে শুনিনি।
অন্য একটা চেয়ার থেকে আমার পাশে এসে বসেছেন এক বয়স্কা মহিলা। চীনা ভাষায় বললেন-"মে মিং জি মিতসুইয়া সেনেকা, সিয়ামেন সি সুনা"(আমার নাম মিতসুইয়া সেনেকা, তোমাকে কোথায় যেনো দেখেছি)! আমিও চায়নীজ ভাষায় বললাম-"মে মিং জি কবির। ওহ সি ইয়িন ডু রেন বাঙ্গুরাদেশ"(আমার নাম কবির, বাংলাদেশ থেকে এসেছি)। ঊনি চিনলেন আমার জন্মভুমি প্রিয় বাংলাদেশকে।
তিনি বললেন- ওহ সি ইয়িন ডু রেন নিপ্পন(আমার দেশ জাপান থেকে এসেছি)......। আলাপ হলো তাঁর সাথে। মিজ মিতসুইয়া সনেকা বাংলাদেশে একমাস বেড়ায়ে গিয়েছেন। আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে হংকং এসেছেন, এয়ার পোর্ট থেকেই আমাদের দেখেছিলেন। অন্য সব বুড়ির মতই এই বুড়িও একটু বেশীই কথা বলেন!-প্রথমে আমি কিছুটা বিরক্ত হলেও কেনো জানিনা আমি ওনার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলাম!
মিজ মিতসুইয়া একজন প্রাক্তন ইয়িন "হাং জিয়া" (ব্যাংকার), টোকিওস্থ ব্যাঙ্ক অব চায়নায় কাজ করেছেন।
চায়না ভাষায় দক্ষতা ইংলিশ থেকে বেশী তাই আমাকে তাঁর কথা বোঝাবার জন্য চায়নীজ বেশী বলে! অবশর কাটাচ্ছেন দেশ-বিদেশে ঘুরে। জাপান থেকে বিদেশ ঘুরতে বেড়িয়েছেন নভেম্বর মাসের শেষ দিকে। কথা বলেন "চানজীং" ("চানজীং" হলো জাপানী, চীনা এবং ইংলিশ ভাষার একটা জগাখিচুরী ভার্সন)ভাষায়। মজার বিশয় হলো-আমি নিজেও চানজীংর কাছাকাছি "চিংলিশ"(চীনা এবং ইংলিশ) ভাষায় কথা বলি! "দুচোখ ভরে দেখতে এবং জানতেই জীবনের সব আনন্দ"-এটা হলো মিজ মিতসুইয়ার থিওরি।
বাংলাদেশ ভ্রমনের পুর্বে তিনি মালদ্বীপ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান মিয়ানমার ভ্রমন করেছেন।
বাংলাদেশের ঢাকা ছারাও পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লা, বাগেরহাট, বগুড়া এবং দিনাজপুর ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের আতিথিয়েতার ভুয়সী প্রশংসা করলেন। নিজ দেশের প্রশংসা একজন বিদেশীর মুখে তাও আবার শান্তিপ্রিয় জাপানী বৃদ্ধা মহিলার মুখে শুনে খুশীতে আমি আল্পুত হয়ে যাই। আমার নোট বইয়ে তিনি নিজ হাতে তাঁর নাম ঠিকানা লিখে দিলেন। কথা প্রসংগে জানালেন-তাঁর বয়স ৭০।
আমি তাঁর বয়স শুনে অবাক হলাম। তাকে দেখতে ৫৫/৬০ বছরের মধ্যে মনে হলেও তার ফিজিক্যাল ফিটনেস অত্যন্ত ভাল। আমি তার সাথে কথা বলছি আর অবাক হয়ে ভাবছি-মনে কত সুখ, সাহস এবং আর্থীক স্বচ্ছলতা থাকলেই ৭০ বছর বয়সে একজন মহিলা একাকী নিজ দেশ ছেরে অনেক অনেক দুরের অচেনা-অজানা দেশ এবং পরিবেশে সবকিছু দেখার জন্য বের হতে পারেন! আমাদের দেশে এই বয়সে এমন বয়সী বাবা-মায়েরা কতটা অসহায়বস্থায় দিন কাটায়!
মিজ মিতসুইয়া সনেকা এখানে উঠেছেন "Motel-168"এ। Motel-168 জাপান-অস্ট্রেলিয়া-হংকং মালিকানায় জয়েনভেঞ্চার চেইন হোটেল। সারা বিশ্বে ওদের এক হাজারের বেশী ব্রাঞ্চ আছে।
যেই সব দেশে Motel-168 আছে সেইসব দেশে বেড়াতে যাওয়া চায়নীজ-জাপানীরা Motel-168 ছেড়ে অন্য কোন হোটেলে নর্মালী উঠবেনা।
প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর ৪ জনার টেবিলে আমরা তিন জন বসেছি। ১ জনের জন্য বরাদ্দ টেবিল সহসাই খালি হবার কোন সম্ভাবনা নাই দেখে মিজ মিতসুইয়া আমাকে রিকোয়েস্ট করলেন-আমাদের টেবিলের খালি সীটে বসতে পারেন কিনা? আমি সানন্দে তাঁকে বসতে বললাম। আমরা এক টেবিলে তিন দেশের চারজন নাগরিক চার ধরনের খাবার খেলাম। মিজ মিতসুইয়া বয়স্ক মহিলা হলেও অনেকখানি খাবার খেলেন।
তিনি তাঁর ব্যগের ভিতর থেকে চপস্টিক বের করে সেই চপস্টিক দিয়ে খেলেন। হোটেলের চপস্টিক ব্যবহার করেননি। যদিও এই হোটেলের সব চপস্টিক ওয়ান টাইম ইউজ করা হয়। তার খাবারের ভিতর ছিল হ্যামারহেড শার্ক ফিন স্যুপ, অক্টোপাস, বড় সাইজের দুইটা ঝু রো (পটকামাছ) মিক্সড সালাদ এবং সামান্য পরিমান আটালো সাদা ভাত(আমাদের দেশীয় জাউভাতের মত দেখতে)। কোনটা কি খাবার, খাবারের রন্ধন প্রনালী এবং স্বাদ কেমন-তা আমাদের বলেছেন মিজ মিতসুইয়া।
প্রতিটি খাবার তিনি আলাদা আলাদা খেলেন। অর্থাৎ কোন খাবার অন্য পদের খাবারের সাথে মিশিয়ে খাননি। এমনকি ভাতের সাথেও কিছু মিশাননি। সকলের খাবার শেষে আমাদের বিলের সাথে আমি সৌজন্য করে তাঁর খাবার বিল দিতে চাইলে বললেন-"This very regular habit of you Bangladeshis. We are always seen to pay the bill after the meal!" আমারা আমাদের বিল দিচ্ছি এমন সময় মিজ মিতসুইয়া কিছু সময়ের জন্য চলে যান। ফিরে এসে সাজিদের হাতে ইয়া বড় একটা প্রিংগল চিপ্স'র বোতল দিলেন! আমি না করতেই সাজিদের মাথায় হাতবুলিয়ে বললেন-হি ইজ লাইক মাই "সান ঝি"(গ্রান্ড সন্স), আই মিসিং হিম! তারপর আর নাকরার সুযোগ ছিলনা।
মিজ মিতসুইয়া চলে যাবেন তার হোটেলে ইয়েলো ক্যাব নিয়ে। যেহেতু আমাদের সাথে গাড়ি আছে-তাই আমরা তাঁকে লিফট দেই তাঁর হোটেলে। আমাদের হোটেল থেকে তার হোটেল ওয়াকিং ডিস্টান্স ১৫ মিনিটের মত।
আমরা তাঁকে জানালাম আমরা হংকং থাকব আরো ৩ দিন, তারপর চলে যাব বেইজিং। মিজ মিতসুইয়া হংকং থেকে চলে যাবেন সাংহাই, কুনমিং, ক্যান্টন, নাঞ্জিং, নানটং সব শেষে বেইজিং।
বেইজিং থেকে যাবেন থাইল্যান্ড। তারপর আবার ফিরে যাবেন জাপান। তিনি কোথায় কোথায় যাবেন, কি কি দেখবেন-তার সব কিছুরই একটা মাস্টার প্লান করা আছে এবং ডাইরীতে সব লিখা আছে। মিজ মিতসুইয়া চলে যাবার সময় তার সাথে যেকোন দিন লাঞ্চ/ডিনার কিম্বা টি পার্টিতে জয়েন করা এবং গল্প করার জন্য তাঁর হোটেলে আমন্ত্রন জানালেন। আমাদের কাছে তিনি বাংলাদেশের আরো কিছু জানার আগ্রহ দেখালেন।
উনি যখন বাংলাদেশে ভ্রমন করেছিলেন-তখন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন থেকে তাঁকে একজন গাইড দেয়া হয়েছিল-যিনি তাকে পর্যাপ্ত সময় দেননি বলে অভিযোগ করলেন। তার ব্যাপারে পর্যটন কর্পোরেশনে অভিযোগ করার পরও প্রত্যাশিত কোন ফল পাননি বলে অনুযোগ করলেন। তিনি আরো বললেন তোমাদের দেশের গাইডদের প্রফেশনালিজমের ঘাটতি আছে। সেই গাইড মহাস্থানগড়, চট্টগ্রাম এবং ময়নামতি সিমেট্রি সম্পর্কে তাঁকে স্বচ্ছ কোন ধারনা দিতে পারেনি। সব চাইতে বড় অভিযোগ ছিল-তাকে বহন করা পর্যটন কর্পোরেশনের গাড়িতে প্রতি বারই কোন অনাহুত যাত্রী তুলে নিয়েছে নানান বাহানায়! লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বলধা গার্ডেন তাঁর খুব ভালোলেগেছে।
আমি শুধু টেনশনে ছিলাম-হয়ত বলবে তোমাদের রাস্তায় অনেক ভিক্ষুক, তোমাদের অমুক যায়গায় আমার সর্বোস্ব ছিনতাই হয়েছে-অমন সব কথা শুনতে হয় ভেবে। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ তিনি কোন প্রতারক বা ছিনতাইকারির খপ্পরে পরেননি।
মিজ মিতসুইয়া হংকং'এ কি কি দেখবেন, কোথায় কোথায় যাবেন তা আমরা জেনে নিলাম। আমরা তাঁকে আমাদের "ফ্রীস্টাইল" প্রগ্রাম জানালাম এবং একদিন আমাদের সাথে খাবার খেতে অনুরোধ জানালাম। মিজ সুকসুক আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে যান তার গন্তব্যে।
প্রতিদিনের মত হোটেল রুমে ফিরে যাবতীয় কাজের এবং ভ্রমন বিশয়ক টুকিটাকি টাইপ করছি। আমাদের রুমে টিভি, হোম থিয়েটার আছে। আমি টি ভি তে সব সময় কার্টুন ছবি দেখতে লাইক করি। ছেলে লাইক করে ইংলিশ ফুটবল। ছেলে একবার হোম থিয়েটারে হংকং-চায়নার উপর ডকুমেটারি ছবি দেখছে আবার টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে।
আমার যেহেতু কার্টুন দেখার সুযোগ নেই-তাই ঘুমিয়ে পরি।
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।