সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৩
ঠিক সারে পাঁচটার সময় মিজ ফেং তার স্বামী(তাঁদের কোম্পানীর চেয়ারম্যান)তাদের একমাত্র মেয়ে সন্তাণ এবং তাঁর বৃটিশ স্বামী (দুজনেই কোম্পানীর ডাইরেক্টর) এবং কোম্পানীর আরো ২ জন বৃটিশ ডাইরেক্টরসহ আমাদের হোটেলে এলেন। সাথে আমাদের জন্য অনেক গিফট। গিফটের ভিতর আছে চায়নীজ কারুকাজ করা রেশম/সিল্ক কাপড়ের উপড় ওয়াল ম্যাট, চীনা ঐতিয্যবাহি তৈজষ পত্র, আমার বৌর জন্য অর্নামেন্টস, ছেলেদের জন্য অনেক উপহার সামগ্রী, আইভরী মেড একজোড়া চপ্সটীক(Chopsticks) এবং কোম্পানীর ক্রেস্ট ইত্যাদি। ওনারা আজই আমাদেরকে গিফটগুলো দিয়ে আমাদের সাথে ডিনার করে চলে যাবেন ডালিয়ান প্রদেশে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে মিলিত হবার জন্য। আমিও বাংলাদেশ থেকে তাঁদের জন্য নেয়া গিফটগুলো তাঁদের হাতে দিলাম।
আমি তাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের শহীদ মিনারের, জাতীয় সৃতিসৌধের পিতলের রেপ্লিকা। পিতলের লাংগল, রিকশা, শিল্পাচার্য্য জয়নুলের ঐতিহাসিক গরুর গাড়ির তৈলচিত্রের রেপ্লিকা, কাঠের উপড় খোদাই করা বাংলাদেশের মানচিত্র এবং আড়ং থেকে কেনা আরো কিছু ফতুয়া, লুংগী ইত্যাদি।
লুংগীর সাথে একমাত্র ডেনিয়েল আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। তিনি সবাইকে লুংগী বের করে দেখালেন এবং বললেন এটা কি করে পড়তে হয় কেউ পারলে দেখাও। সবাই হাতে নিয়ে অনেক চেস্টা করলো-কিন্তু সবাই লুংগী দেখে অবাক! এটা কি করে ইউজ করবে-এটায় কোন বেল্ট নেই, জিপার-বোতাম নেই! পরে আমি সকলকে দেখালাম কি করে লুংগী পরতে হয় এবং খুব মজা করে লুংগীর উপকারিতা বর্ণনা করলাম।
লুংগীর উপকারিতার কথা শুনে ওরা হাঃ হাঃ পঃ গেঃ অবস্থা!
গিফট পর্ব শেষ হবার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বেইজিং তথা চায়না'র অন্যতম অভিজাত Beijing Hui Zhen Restaurant. ঐ রেস্টুরেন্টে আমাদের জন্য আগে থেকেই বুকিং দেয়া হয়েছিল। ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা ঐ রেস্টুরেন্টে পৌঁছি। হোটেলে পূঁছতেই একদল মিউজিশিয়ান পোঁ পোঁ করে বিভিন্ন বাদ্য বাজালো। আমরা সাকুল্যে ১৬ জন একসাথে ডিনার করেছিলাম। চায়নীজ মালিক, শ্রমিক, ড্রাইভার সবাই এক টেবিলেই একসাথে খাবার খায়।
চায়নীজ অফিশিয়াল ডিনার মানেই অনেক অনেক রকমের খাবারের ছড়াছরি। এরা খুব অতিথিপরায়ন এবং খাবার অপচয়কারি। আমি চপস্টিকে খেতে পারি। কিন্তু আমার ছেলে চপস্টিক ইউজ করতে পারেনা। প্রায় ১০ মিনিট পর ওর জন্য চপস্টিক'র পরিবর্তে কাটা চামচ নিয়ে আসা হল(মনে হয় বাহিরে গিয়ে দোকান থেকে কিনে এনে থাকবে)।
আমরা ডিনারে কি খাবো তা সম্ভবত আগেথেকেই রেস্টুরেন্ট কর্তিপক্ষকে জানানোছিল-কারন আমি কোনো খাবারের অর্ডার দিতে দেখিনি। আমি অনেক্ষণ যাবত গুনে দেখেছি আমাদের জন্য ৩২ টি বিচিত্র ধরনের খাবার আইটেম। খাবারের নাম মুখস্ত করতে করতে বাকী আরো কত গুলো খাবার খেতে দেয়া হয়েছিল-তা মনে রাখতে পারিনি। তবে বলতে গেলে সেই সব খাদ্যই রান্নার নামে জাস্ট সামান্য সিদ্ধ করা। অর্থাত সব খাবারই কাঁচা/ তাজা।
প্রতিটি খাবার খেয়েই সবাই সমস্বরে বলবে-"জেন শি তাই জিয়াং লি"(Food is really delicious!)-আমিও খাবার মুখে নাদিয়েও বলি ডেলিসিয়াশ ওদের সাথে সুর মিলিয়ে!
এই রেস্টুরেন্টের আর একটা বিরক্তিকর বিষয় হলো-একদল মিউজিশিয়ান ঘুড়ে ঘুড়ে মেহমনদের সামনে/পিছনে মিউজিক পরিবেশন করে-অনেকটা সেই টাইটানিক ছবির মত। যখনই কোনো নতুন ডিশ নিয়ে আসে-ওরা পোঁপোঁ করে বাঁজায়(অনেকটা বিউগল বাঁজানোর স্টাইল)! খাবারের গন্ধে সাজিদ ইতোমধ্যেই কয়েকবার বমি করে ক্লান্ত হয়েগিয়েছে। একেতো খাবার নিয়ে অরুচী তারুপড়ে ঐ মিউজিশিয়ানদের মিউজিক! আমি সয্য করলেও সাজিদ বিরক্ত হয়ে বাংলায় বললো-"এই ওরাংওটাং গুলা এমন ছাগলামী করে ক্যা"? ভাগ্যিস ওরা মিউজিকের শব্দে "ওরাংওটাং" শব্দটা শুনতে পায়নি। কারন ওরাংওটাং চায়নীজ শব্দ।
চায়নীজদের খাবার বিশয়ে আমি গতবছর আমার চায়না ভ্রমনে বিস্তারিত ভাবে লিখেছিলাম।
কাজেই আবারো সেই একই লেখা লিখে আপনাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে চাইনা। শুধু দু'একটি স্পেশাল মেন্যুর কথা না লিখলেই নয়। তাহলোঃ খাবার শেষ পর্যায় আমাদের প্রত্যেকের সামনে দেয়া হলো রযাপিং করা চমতকার একটা করে বর্ণীল কাঠের হাতুড়ী। আরো দেয়া হয়েছে ছোট্ট একটা করে স্বচ্ছ ক্রিস্টালের বোতল(হোমিওপ্যাথি ঔষধের শিশির মত দেখতে) যার উচ্চতা ২ ইঞ্চির মত। বোতল দেখতে অনেকটা অর্নামেন্টস(আংটির বক্স) বক্সের মত কারুকাজ করা।
হাতুড়ী আর কাঁচের শিশি দেখে আমিও যেমন ভরকে গিয়েছি-তেমনি আমার ছেলে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো-"আব্বু এখন কি ঐ "হাতুড়ী আর কাঁচের বোতল"ও খেতে হবে"?
আমি বল্লাম-"আল্লাহ মালুম"!
এবার নিয়ে আসা হলো বিশাল সাইজের একটা করে "ক্যারাবিয়ান রেড কিং ক্রাব" ফ্রাই। প্রতিটা ক্রাবের ওয়েট এক কেজির উপড়ে! হাতুড়ী দিয়ে ঐ ক্রাবের "ঠ্যাং বাইড়াইয়া" ভাংতে হবে ঠ্যাং এর ভিতরে থাকা সাদা শাস বের করে খাবারের জন্য! এই খাবারে আমার কোনো অরুচী নেই। এরপর এলো বিশাল সাইজের(প্রায় ৬"x৪" সাইজের)ঝিনুক। আমি অত বড় ঝিনুক পুর্বে কোন দিন দেখিনি। ঝিনুক গুলো হা করা।
যেনো ঝিমুকগুলো এখনই আমাদের খেয়ে ফেলবে! ভিতরটা সামান্য সিদ্ধ। রঙ শ্বেতী রোগীর চামড়ার মত সাদা ফ্যাকাশে। ঝিনুকের ভিতরের লালা বের হয়ে পরছে তখনো। ঝিনুকের পরিচয় করা হলো এভাবে-এই ঝিনুকগুলো মেকং নদীর ন্যাচারাল ঝিনুক...এমন উন্নত প্রাকৃতিক ঝিনুক মেকং নদি ছারা শুধু মাত্র ক্যারাবিয়ান সাগরে পাওয়া যায়। এমন স্বুস্বাদু ঝিনুক চীন এবং ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ছারা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবেনা-ইত্যাদি।
আমরা বাপ-বেটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম "হাতুড়ী" কিম্বা "বোতল" খেতে হবেনা ভেবে! কাকড়া খাওয়াটা আমার পরিচিত-কাযেই কোনো অসুবিধা হয়নি। এবার ঝিনুক খাবার পর্ব। সামান্য বিট লবন ছিটিয়ে সবাই খুব হৈ হুল্লোর করে ঝিনুক খাচ্ছে। কিন্তু আমি আর আমার ছেলে অন্য অনেক খাবের মতই তা স্পর্শ করছিনা। আমার এক পাশে বসেছেন মিজ ফেং, অন্যপাশে ডেনিয়েল।
ডেনিয়েল আস্তে করে বললো-না খেতে চাইলেও খাবার ভান কর, চামচ দিয়ে নাড়াচড়া করতে থাকো। ঐ ঝিনুকের ভিতর "ঝোন ঝু"(খাটি মুক্তা)আছে। ওরা সবাই খাচ্ছে। আমি আমার ঝিনুক কেটে কেটে কিছু মিজ ফেং'কে এবং কিছু তার বৃদ্ধ স্বামীর প্লেটে তুলে দিচ্ছি। ওরাও আমার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে।
কারো প্লেটে খাবার তুলে দেয়া চীনাদের কাছে খুব সম্মানের বিশয়। ঝিনুকের সাথে লেগে থাকা পর্দার নীচে উঁচু উঁচু দেখে যেইনা ওখানে খোঁচা দিয়েছি অমনি ইয়া বড় একটা গোলাপী মুক্তা বেড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে সবাই "কুয়ান জুন"- "কুয়ান জুন"(বাংলায় কুয়ান জুন শব্দের অর্থ হুররে! হুররে!! টাইপের হবে) বলে উল্লাস করতে থাকলো। এমনি করে যে যখন মুক্তা পাচ্ছে-সবাই "কুয়ান জুন" বলে আনন্দ প্রকাশ করছে।
সাজিদ ঝিনুক দেখে দূরে চলেগেছে।
হোস্টদের অনুরোধে আমিই আমার ছেলের ভাগের ঝিনুক থেকে মুক্তা বের করি। ওর ভাগ্যে পরেছে নীল মুক্তা। সব মুক্তাগুলোই বিভিন্ন বর্ণের(কোনটা কালো, গোলাপী, নীল এবং হালকা গোলাপী কিম্বা সোনালী রঙ) এবং এবনর্মালী বড় সাইজের। এমনি করে মিজ ফেং এর কোম্পানীর ৫ জন অফিসিয়ালস যে মুক্তা পেয়েছেন তা সব আমাকে এবং সাজিদকে দিয়েদিয়েছে! তবে ডেনিয়েল, তার বৌ এবং বাচ্চা, মিজ দুয়ো এবং ড্রাইভার'র মুক্তো তারাই নিয়ে গিয়েছে। এটা হলো চায়নীজদের মেহমান্দের সর্বোচ্চ সম্মানীত করার একটা পদ্ধতি।
ঐ যে স্বচ্ছ কাঁচের শিশি দেয়া হয়েছিল-সেই শিশিগুলোতে এই মুক্তাগুলো রাখার জন্য দেয়া হয়েছিল। আমি ব্যাবসা উপলক্ষে প্রায় ২০/২২ বছর যাবত চায়নাতে আসি-কিন্তু এর পুর্বে কোন কোম্পানীর পক্ষ থেকে এমন সম্মান আর পাইনি।
ডিনার শেষে আমাদের থেকে সবাই চলে যাবার সময় মিজ ফেং জানালেন-আমাদের থাকা বেড়ানোর যাবতীয় দায়-দ্বায়িত্ব ডেনিয়েল এবং তাঁর কোম্পানীর সেকেন্ড সেক্রেটারী মিজ দুয়ো করবেন। আমরা যেদিন (৯ ফেব্রুয়ারী)বেইজিং ত্যাগ করবো সেদিন রাতেই মিজ ফেং বেইজিং চলে আসবেন।
হোটেলে ফেরার পথে প্রায় বন্ধ হতে যাওয়া একটা কে এফ সি দোকানের সামনে গাড়ী দাড় করালো ডেনিয়েল-আমাদের, স্পেশালী সাজিদের জন্য খাবার কিনতে! কারন প্রায় অর্ধ শত প্রকার "খাবার দেখেও" সাজিদের পেট ভরেনি!! বরং কয়েকবার বমি করেছিল।
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।