সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৭
ডেনিয়েলের ছেলে ইয়াং শি সারাক্ষন সাজিদের সংগী হয়ে থাকে। দুনিয়ার সব কথা ওরা দুজনে বলে। যখন কোনো কথা ইয়াং শি বুঝতে পারেনা-তখন ওর মা-বাবার হেল্প নেয়। সাজিদ আমার হেল্প নেয়। ইয়াং শি সাজিদ কে চায়নীজ বর্ণমালা লিখে জানতে চায়-কি লিখেছ? সাজিদ বলতে পারেনা।
তখন ইয়াং শি অবাক হয়ে ওর মা কে বলে- এত্ত বড় সাজিদ চায়নীজ বর্ণমালার প্রথম অক্ষরটাও চিনেনা! আমি বলে দেই-ইয়াং কি লিখেছে। আবার ইয়াং শি কাউন্টিং নাম্বার লিখে-সাজিদ জিজ্ঞেস করে কি লিখেছে। সাজিদ ঝটপট বলে দেয়। এবার ইয়াং শি অবাক হয়......। পাঠক, চায়নীজরা কিন্তু সর্বত্র নম্বরগুলো ইংলিশে লিখে-অর্থাৎ 1, 2,3, 4, 5..........।
সাজিদ তখন ওকে বাংলা বর্ণমালার 'অ', 'ক' এবং '১' লিখে বলে -বলো এটা কি লিখেছি? ইয়াং শি বলতে পারেনা, ওরা আব্বু-আম্মুও বলতে পারেনা। এমন দুস্টুমীতে ওরা সারাক্ষণই কাটিয়েছে।
আজ সারাদিন আমরা চায়নার বিভিন্ন মল/ ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ঘুরেছি। কিছু কিছু কেনা কাটাও করেছি। সাজিদ যা কিছু কিনে-তার দাম দিবে মিজ দুয়ো কিম্বা ডেনিয়েল......।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে প্রথম যাই বেইজিং অলিম্পিক-২০০৮ এর বিখ্যাত ভেন্যু "বার্ডস নেস্ট" স্টেডিয়াম (চায়না ন্যাশনাল স্টেডিয়াম)দেখার জন্য। ৮০ হাজার দর্শক ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়াম নির্মিত হয় সম্পুর্ণ ষ্টীল স্ট্রাকচারের উপড়। ৮০ হাজার ধারন ক্ষমতা থাকলেও এখানে আরো অতিরিক্ত ১১ হাজার আসন ব্যাবহারের সুযোগ আছে। ২০০৮ এর অলিম্পিকের সময় এখানে ৯১ হাজার দর্শকের আসন বিন্যাস করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত আর্কিটেকচার প্রতিষ্ঠান Herzong & De-Meuron এবং ArupSport China Architectural Design & Research Group এর সম্মিলিত ডিজাইনে নির্মিত এই স্টেডিয়ামের নির্মাণ ব্যয় ৪২৩ মিলিয়ন ডলার।
২০০৮ সনের সামার অলিম্পিকের ট্রাক এন্ড ফিল্ডের মেইন ইভেন্টগুলো এবং অলিম্পিক ফুটবল ফাইলান খেলা এখানে অনুষ্ঠীত হয়েছিল। বর্তমানে স্টেডিয়ামের ভিতর বাহির বিভিন্ন ইভেন্টের জন্য কমার্শিয়াল ইউজের(শপিং সেন্টার, খেলাধুলা, থিয়েটার এবং বেইজিং ইউনিভার্সিটির ফুটবল মাঠ হিসেবে) জন্য ভাড়া দেয়া হয়। এখনো বার্ড নেস্ট দেখতে প্রচুর দর্শকের ভীর। স্টেডিয়ামের বাহিরে বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের ভীড় লেগেই আছে। ৫ আরএমবি দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকতে হয়।
বিকেলে দেখতে যাই পৃথিবীর সর্ব বৃহত শপিং সেন্টার "সাউথ চায়না মল" দেখতে। আমাদের দেশে কিছু দিন পুর্বেও একটা বিজ্ঞাপন দেয়া হত- "এশিয়া মহাদেশের সব চাইতে বড় শপিং সেন্টার "যমুনা ফিউচার পার্ক"! কথাটা মোটেই সত্য নয়। যমুনা ফিউচার পার্ক অনেক বড় একথা মিথ্যা নয়। তবে নিশচই এশিয়া মহা দেশের সব চাইতে বড় নয়। ইদানীং যমুনা ফিউচার পার্কের বিজ্ঞাপনে কিছুটা চেঞ্জ করা হয়েছে।
"সাউথ চায়না মল" সম্পর্কে কিছু ধারনা দিচ্ছি। বেইজিং শহরের অনতি দুরের Dongguan সিটি এলাকায় সাউথ চায়না মল স্থাপিত। প্রথমে এই মল নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় Shangri-La Hotel কর্তিপক্ষ। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে করা হয় চায়না সাউথ মল। ২০০৫ সনের শেষের দিকে এই মল চালু হয়।
তবে এখনো এর উন্নয়ন কাজ চলছে। ২০১০ সনে এর নির্মাণ কাজ পুর্নাংগ সমাপ্তি হবে। এই মলের শুধু মাত্র ভাড়ার জন্য ফ্লোর স্পেস আয়তন ৭ মিলিয়ন প্লাস স্কয়ার ফিট। মলের বাইরেও প্রায় ১০০ একর জায়গা জুরে রয়েছে মলের বর্ধিতাংশ। এখন পর্যন্ত এটাই পৃথিবীর সর্ব বৃহত শপিং মল।
এই মল সাতটি ভাগে তৈরী করা হয়েছে পৃথিবীর উল্যেখযোগ্য কয়েকটি সিটি এবং স্থানের আদলে। তারমধ্যে উল্যেখযোগ্য হলো-মিশর, ভেনিস, প্যারিস, ক্যালিফোর্নিয়া, আর্মস্টাডাম এবং ক্যারিবিয়ান মডেল। মলের ১৫০০ টি মেঘা স্টলের ভিতর পৃথিবীর সকল বিখ্যাত চেইন শপের স্টল আছে। আছে বোয়িং, এয়ার বাস বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্টল। মলের ভিতর অন্যান্য সব বিখ্যাত মল সমুহের সুযোগ সুবিধা ছারাও ফাইভ স্টার হোটেল আছে, লেক আছে, লেকে বোটিং করার সুবিধা আছে, পিকনিক স্পট ছারাও মল ঘুরে দেখার জন্য আছে ইন্ডোড়-আউটডোড় রোলার কোস্টার এবং ৫৫৩ মিটার লম্বা ফ্লাইং রেল(আকাশ/মনো রেল)সিস্টেম।
পুরো মল ঘুড়ে দেখার জন্য কিম্বা শপিং করার জন্য মল কর্তিপক্ষের সার্ভিস কারের ব্যবস্থা আছে।
চায়নাতে যে কোন অতিথি গেলেই চায়নীজরা তাদের অতিথিকে পৃথিবী বিখ্যাত "ইয়া জি" (চায়না ডাক) রোস্ট খাওয়াবেই। চায়না ডাক রোস্ট খাওয়ানোটাও ওদের অতিথি আপ্যায়নের একটা ঐতিয্য। আজ আমাদের চায়না ডাক খাওয়াতে নিয়ে যাবে। বেইজিং এর সব চাইতে পুরোনো আন্তর্জাতিক মানের চায়না ডাকের স্পেসালাইজড রেস্টুরেন্টের নাম Quanjude Roast Duck Restaurant যার প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬৪ সন।
ঐ রেস্টুরেন্টে আমি আগেও খেয়েছি তাই এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটা রেস্টুরেন্টে যার নাম Bianyifang Roast Duck Restaurant আজ আমি নিজেই অনেকগুলো খাবারের অর্ডার করেছি সাজিদের কথা ভেবে। কারন এই কয়দিনে সাজিদ পছন্দ মত খাবার নাখেতে পেরে সে শারিরিক কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছে। এই হোটেলের খাবার খুব বেশী কস্টলী। এখানে ৮০% গেস্টই বিদেশী। হোটেলটি পরিচালনা করে চায়না ন্যাশনাল টুরিজম কর্পোরেশন।
এখানে হোটেলের বেশীর ভাগ স্টাফগন ইংলিশে কথা বলে। এই ধরনের হোটেল রেস্টূরেন্টে খাবার খেতে চপস্টিকের পাশাপাশি কাটা চামচ সরবরাহ করা হয়।
ডেনিয়েল বাংলাদেশে এসে আমাদের দেশীয় চায়নীজ হোটেলে খেয়ে বলেছিল-"সারা চীন খুঁজেও তোমাদের দেশীয় "চায়নীজ" খাবার এর মত একটি খাবারো চায়নাতে পাবেনা"। কথাটা অনেক বেশী সত্য। আমাদের দেশে যে চায়নীজ নামক খাবার বিক্রয় করা হয়-তা খোদ চীন সাম্রাজ্যের কোথাও নেই! তারপরও আমি ফ্রাইড চিকেন রাইস, কিং লবস্টার সহ কিছু কিছু খাবার পছন্দ করে খাবারের অর্ডার করি-যা মিজ দূয়ো এবং ডেনিয়েলের পছন্দ নয়।
ওরা ওদের মত খাবারের অর্ডার করে। সব শেষে এলো ঐতিয্যবাহি "ইয়া জি" (চায়না ডাক রোস্ট)। ড্রাইভার সহ আমরা পাঁচ জনের জন্য বিশাল সাইজের ২ টি ডাক রোস্ট অর্ডার করি। চায়না ডাক রোস্টের সত্যি একটা স্পেসালিটি আছে-যা শুধু স্বাদেই নয় দেখায়ও। হাঁসটা সম্পুর্ণ আস্ত।
ধব ধবে পরিস্কার, কিন্তু শরিরের রঙ লাল। গায়ে তেল চকচক করে। পেট কেটে ভিতরের নাড়ী ভুড়ি বের করে আস্ত রোস্ট করা। অথচ কোন মশলা দেখা যায়না। খেতে ভীষন সুস্বাদু।
সাজিদ খাচ্ছেনা। আমাকে আস্তে করে বললো-"আব্বু, ওরা হাঁসটা জবাই করেনি। হয়ত হাঁসটা মরা ছিল কিম্বা শুধু পেট কেটে মেরে ফেলা হয়েছিল"।
আমিও লক্ষ করে দেখলাম হাঁসের পেট ছারা অন্য কোথাও কাটাছেড়া নেই। মাথাটা সহ এমনকি পা-পাখাগুলো পর্যন্ত খেতে দেয়া হয়েছে।
তাহলে হাঁসে রক্ত কি শুধু পেট কেটেই বের করা হয়েছিল? এত সব ভাবার পুর্বেই আমার অনেক খানি খাওয়া শেষ! আমার ছেলে শুধু ফ্রাইড চিকেন রাইস থেকে বেছে বেছে রাইস এবং লবস্টার খেলো। এখানে খাবারের সময় পানি দেয়া হয়না। পানির পরিবর্তে বিয়ার দেয়া হয়। এদের ছেলে বুড়ো সবাই বিয়ারে অভ্যস্থ। আমার ছেলের জন্য প্রতিবার খাবারের পুর্বে কোন ডিপার্ট্মেন্ট স্টোর থেকে ৫ আরএমবি দিয়ে একবোতল(২ গ্লাশ/১ লিটার)পানি কিনে নিতে হত।
অথচ এক বোতল(প্রায় ৩ গ্লাশ)বিয়ারের দাম মাত্র ২ আরএমবি। এই সব রেস্টূরেন্টে কোক/ পেপ্সী ক্যান পাওয়া যায় যার দাম ৫ আরএমবি।
এই হোটেলের বাড়তি আকর্ষন হচ্ছে-চায়না নিউ ইয়ার উতসব উপলক্ষে বিদেশী অতিথিদের জন্য মনোমুগ্ধকর নানান অনুষ্ঠান। যা আয়োজন করেছে- চায়না ন্যাশনাল টুরিজম কর্পোরেশন। এখানেই আমি খুব কাছে থেকে লাইভ চায়নীজ এক্রোবেটিক শো উপভোগ করি।
আমরা রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করে হোটেলে ফিরি।
আজ লাঞ্চ শেষে ডেনিয়েলের বৌ এবং বাচ্চা চলে গিয়েছে গ্রামের বাড়ি। যার দুরত্ব বেইজিং শহর পেরিয়ে ১৬০ কিঃ মিঃ দক্ষিনে। আগামীকাল আমরাও ওদের গ্রামে বেড়াতে যাব চায়নীজ নিউ ইয়ার ফ্যাস্টিভাল দেখার জন্য। আমাদের যাবার পুর্ব প্রস্তুতির জন্যই তিনি আগে চলে গিয়েছেন।
চায়নার ২য় শীত প্রধান এলাকার নাম হার্ভিং। হার্ভিং একটি গ্রাম। যা ডেনি্যেলের শশুর বাড়ি থেকে আরো ১০০ মাইল দূরে। চায়নার সব চাইতে বেশী শীত পরে আনসুয়ান গ্রামে। সেইসব যায়গায়ও আমার যেতে মন চায়-কিন্তু সময় কুলাবেনা বলে সেখানে যাওয়া হবেনা।
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।