সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
জার্ণী টু চায়নাঃ(বেইজিং)-১৮
আমরা যাচ্ছি-Ngai Sai. এটা বেইজিং থেকে ১৬০ কিঃমিঃ দুরে একটি মডেল গ্রাম। ২০০০ সালে চায়না সরকার চায়নার ৫০ হাজার গ্রামকে "মডেল গ্রাম" হিসেবে নির্ধারন করে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রামটিও মডেল গ্রামের অন্ত্র্ভুক্ত। এটাই বন্ধু ডেনিয়েল শি'র শশুর বাড়ি। আমাদের সংগী ডেনিয়েল আর যথারিতি মিজ দুয়ো।
আজ গত কদিনের থেকে শীত কিছুটা কম। যখন আমরা বেইজিং থেকে যাত্রা শুরু করি তখন গাড়ির ভিতরে তাপমাত্রা দেখেছিলাম ১ ডিগ্রী। যতই শহর পেরিয়ে দূরে যাচ্ছি-বাইরে শীতের তীব্রতা বেড়েই যাচ্ছে-৪৫ মিনিট পর এখন সেই তাপমাত্রা দেখাচ্ছে মাইনাস ৪ ডিগ্রী। রাস্তায় জমে থাকা পাতলা বরফস্তরের উপড় দক্ষ হাতে ড্রাইভার মিজ উলা ড্রাইভ করছেন। এইধরনের বরফের উপড় ড্রাইভ করা খুব কঠিন।
কারন একটুখানি অশতর্ক হলেই বড় দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে।
এমন কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও রাস্তায় নানা ধরনের প্রচুর পরিমান যান্ত্রিক যানবাহন( বিভিন্ন প্রকার ছোট গাড়ি, বাস, ট্রাক, ট্রাক্টর, ট্রেইলার, প্রাইম মুভার) এবং মোটর সাইকেল, সাইকেল চলছে। পাঠক, চায়নাতে কোথাও বিদ্যুত ঘাটতি নেই। তারপরেও সকলস্তরের জনগন সরকারের বিদ্যুত সাশ্রয়ী নীতি মেনে চলছে কঠোর ভাবে। চায়নাতে ১০০ ভাগ মোটর সাইকেল এবং ছোট যানবাহন অবশ্যই রি-চার্জাবল ব্যাটারী চালিত।
সকল (১০০ ভাগ) বসত বাড়ি, অফিস, কারখানায় সৌর বিদ্যুত থাকা বাধ্যতা মুলক। যেহেতু চায়না শীত প্রধান দেশ-তাই গড়ম পানি ব্যাবহার করতেই হয়। সেক্ষেত্রে পানি গড়ম করা বাধ্যতামুলক সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে। তাই চায়নার সকল আবাসিক-অনাবাসিক, সরকারী-বেসরকারী ভবনে সৌর বিদ্যুত প্যানেল বসানো আছে-যা সৌন্দর্য্যের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই সৌর বিদ্যুত সুদুর গ্রাম-গঞ্জে পর্যন্ত বিস্তৃত।
পথে আমরা একটা "W & C"(ওয়াশ এন্ড ক্লিনিং সেন্টার, এখানে একাধারে ফুয়েল/গ্যাস পাম্প স্টেশন, বিলাশ বহুল রেস্টুরেন্ট/বার, বিশ্রাম কক্ষ/হোটেল রুম এবং বাচ্চাদের জন্য এমিউজমেন্টের সুব্যবস্থা থাকে-যা আমেরিকার সকল লং রুটের হাইওয়েতে দেখেছি) সেন্টারে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতী দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই। ওখানে ফ্রুটস, ফ্রেঞ্জ ফ্রাই, কফি সহ সামান্য কিছু খেয়ে নিলাম। প্রায় দুই ঘন্টার জার্ণীতে গ্রামে এসে পৌঁছি। আজ এখানে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী। এই গ্রামটা নামে গ্রাম হলেও একটি উন্নত পরিকল্পিত মডেল শহরেরই প্রতিচ্ছবি।
এই গ্রামে শহুরে জীবনের সকল আধুনিক সুবিধা রয়েছে। এই গ্রামে দুই ধরনের বসত বাড়ি রয়েছে। একক বাড়ি আছে ২০ ভাগ, বাকী ৮০ ভাগ বাড়ি আমাদের দেশীয় কলোনীর মত। যা সরকার কর্তিক তৈরী করে দীর্ঘমেয়াদী সহজ কিস্তিতে বরাদ্ধ করা হয়। এখানেও সরকারের নিয়ম নীতি রক্ষা করে পরিকল্পিত বাড়ি এবং বাড়ির ছাদে যথারিতী সেই সৌর বিদ্যুত প্যানেল! অনেক বাড়িতেই নিজস্ব গাড়ি কিম্বা লাগেজ ভ্যান গাড়ি আছে।
সমবায়ী পদ্ধতিতে কৃষকের ট্রাক্টর সহ যাবতীয় আধুনিক চাষাবাদের কৃষি যন্ত্রপাতি আছে। এই গ্রামে সাইবার ক্যাফেও আছে। প্রতি ঘরের শিশু, তরুণ-যুবকেরাই পড়া লেখা করছে। এখানকার পড়া লেখার কয়েকটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ ৬ বছর বয়স পর্যন্ত নার্সারী, ক্লাশ ফোর পর্যন্ত প্রাইমারি, ফাইভ থেকে ক্লাশ এইট পর্যন্ত আপ গ্রেড, এর পর এস এস সি, এইস এস সি সমমান যথা ক্রমে সেকেন্ডারী এবং হায়ার সেকেন্ডারী।
শিশুরা স্কুল বাসে, আপ-গ্রেড থেকে হায়ার সেকেন্ডারীর সকল ছাত্র ছাত্রী বাই সাইকেল/মোটর সাইকেলে যাতায়ত করে।
আমাদের বহনকারী গাড়ি গ্রামে পৌঁছতেই বাচ্চারা আমাদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে সমস্বরে বললো-"হুয়ান ইং, হুয়ান ইং"(ওয়েল কাম)।
আমাদেরকে প্রথমে নিয়ে বসানো হয়-ওদের কমুনিটি সেন্টারে। সেখান থেকে ডেনিয়েলের শশুরের ঘরে নিয়ে যাবার জন্য স্থানীয় কমুনিটি প্রধানের নিকট থেকে কিছু ডকুমেন্টারী ফরমালিটিজ শেষ করতে হলো। যদিও আমাদের আসার পুর্বেই ডেনিয়েলের স্ত্রী বেশীর ভাগ কাজই এগিয়ে রেখেছিলেন।
যেকোনো বিদেশীর জন্য এই নিয়ম। আমাদের পাসপোর্টের ফটোকপি জমা নিয়ে একটা চায়নীজ ভাষায় লেখা ফরম এ সিগ্নেচার করতে হলো, সেই সংগে আমার আর সাজিদের ছবি তুলে রাখা হলো। এখানে এসে জানতে পারি-এই গ্রামে উতসব দেখার জন্য আরো কিছু বিদেশী এসেছেন-অন্য কারো কারো আমন্ত্রনে। যাদের কেউ কেউ গেস্ট হাউজে অবস্থান করছেন। প্রথমেই আমাদেরকে চায়নীজ রীতিমত সবুজ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো-সাথে নানা রকম ফল এবং ফলের জুস।
যদিও সারা পথ জুড়েই আমরা চা পান করেই আসছি।
আমরা এখানে আসবো-সেকথা আগেই যেহেতু গ্রামবাসী জেনেছিল-তাই উতসব অনুষ্ঠানে আসা প্রচুর মানুষ ছুটে এসেছে আমাদের দেখতে। আসলে কিছু কিছু বিষয় আছে-যা দেশ, স্থান কাল ভেদে একই রকম হয়ে থাকে। মানুষের নতুন কিছু দেখার, জানার কৌতুহলও তেমনই স্বার্বজনীন!এমন দৃশ্য আমাদের দেশেও হয় বিদেশীদের দেখলে! আমাদেরকে চায়নীজ শিশু-কিশোরেরাতো বটেই তরুন-তরুণী এমন কি বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত দেখার জন্য হুমড়ীখেয়ে পরেছে। অতি উতসাহি তরুন-তরুনীরা পর্যন্ত সাজিদকে ছুঁয়ে দেখছে! আমরা লাঞ্চ করে নিলাম।
অনেক আন্তরিকতার সাথে ডেনিয়েলের স্ত্রী, শশুর-শাশুরী খাবার পরিবেশন করল। আমাদের জন্য বেশীর ভাগ খাবারগুলো অবশ্য কাছাকাছি কোনো হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে আনা হয়েছে-ডেনিয়েল জানালো।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরি উতসব দেখতে। সাজিদকে নিয়ে গিয়েছে ডেনিয়েল পুত্র ইয়াং শি এবং ওর মা। সাজিদের পিছনে বর্ণীল সাজে স্বজ্জিত ২৫/৩০ জন তরুণ-তরুণী...।
ভাবটা এমন মনে হচ্ছে-সাজিদ ইলেকশন করছে-আর ভোটার সমর্থকরা পিছনে ছুটছে! সাজিদ পুরা ভি আই পি! সাজিদের দোভাষী হিসেবে কাজ করছে ওরা দুজন।
এখানে ৪/৫ টা গ্রাম নিয়ে(লোক সংখ্যা অনুপাতে) একটা পঞ্চায়েত টাইপের সংগঠন হয়। ওরা বলে জেন(কমুনিটি)। প্রতি কমুনিটিতে একটা করে কমুনিটি সেন্টার আছে-যেখানে ওদের সকল অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়। সেই কমুনিটি সেন্টারের সামনেই খোলা মাঠে শামিয়ানা টানানো হয়েছে।
বিছানো হয়েছে শত শত চেয়ার। মঞ্চে কেউ গান গাইছে, কেউ নৃত্য পরিবেশন করছে। কিছু বিদেশী অতিথী স্পেশালী আফ্রিকান অতিথীরাও ওদের সাথে ড্যান্স করছে। জনাকয়েক "পাঙ্কু" পোলাপান ইয়াং মেয়েদের নিয়ে হৈ-হুল্লোর করছে। আজ চায়নীজ নিউ ইয়ার ফ্যাস্টিবলের অন্যান্য উতসবের মধ্যে অন্যতম উতসবের নাম মাংস খাওয়ার উতসব, ড্রাগন ড্যান্স, ফোক সংগীত এবং ফোক ড্যান্স।
এই অনুষ্ঠান শুধু এলাকা ভিত্তিক নয়-অন্য কমুনিটি থেকেও এই কমুনিটিতে উতসব করতে হাজির হয়-আবার এরাও যায় অন্য কমুনিটিতে।
আমরা যেকটা উতসব দেখেছিলাম-তারমধ্যে "মাংস খাওয়া উতসব" আমার কাছে খুব থ্রীলার মনে হয়েছে। মেইন মাংস হয় শুকরেরই-তবে অজগর সাপ, ইঁদুর, ব্যাং, বাদুর, খরগোশ, সজারু, ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষসহ অন্যসব প্রানীর মাংশও থাকে। আমার কাছে শুকরের রান্নাটা অদ্ভুত লেগেছে। এই শুকুরগুলো আমাদের দেশীও শুকরের মত কালো এবং বিদ্গুটে নয়।
এই শুকর সাদা, যা খামারে চাষ করা হয়। উতসবের জন্য যে শুকর খাওয়া হবে-সেই শুকরের পরিচর্যা হয় স্পেশাল ভাবে। ওদেরকে নাকি অন্যান ভাল খাবারের সাথে নিয়মিত "মাও টাই জিউ"(একধরনের চোলাই মদ) খাওয়ানো হয়। যার কারনে এই শুকর অনেক বেশী রিস্ট-পুস্টো, মোটা তাঁজা! এই অনুষ্ঠানে অন্যান্য প্রানীর মাংস- গতানুগতিক বলেই সেগুলো আমার কাছে উল্যেখযোগ্য নয়-তাই সেগুলো উল্যেখ করছিনা। এই কমুনিটিতে আজ প্রায় ৫০/৬০ টা শুকর রোস্ট করার আয়োজন হয়েছে।
শুকরকে চায়নীজ ভাষায় বলা হয়-"ঝু"। "রো" মানে মাংস। "ঝু রো"(শুকরের মাংস)-ওদের সব থেকে প্রিয় মাংস। ওরা হরহামেশাই ঝু রো খায়। তবে এই উতসবএর জন্য ঝু রো বিশেষ কায়দায় রান্না করা হয়।
উতসবের ২ দিন পুর্বে প্রথমেই ভেটেরনারী চিকিতসক এসে রান্নার জন্য সুস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবান শুকর বাছাই করে দেয়। সেই শুকরদের খাওয়ানো হয়-"হি জি" নামক একধরনের লিকুইড পানীয়। হি জি শব্দের অর্থ "জোলাপ"। জোলাপের কি কাজ তা আশা আপনারা সবাই জানেন। জোলাপ খাওয়ানোর পর শুকরের পেট পরিস্কার হয়ে যায়।
একদিন উপোশ রাখার পর শুকরকে খাওয়ানো হয় "পি জিউ"(বিয়ার)ওয়াইন ভেজানো সুগন্ধি চাল, গম, ভুট্টা এবং নানা প্রকার স্বব্জি- ইত্যাদি। ক্ষুধার্থ শুকর মদ/বিয়ার মেশানো খাবার খায় গোগ্রাশে। যতক্ষণ নিজে পেট পুরে খাবেতো খাবেই-তারপর নিজ থেকে খাওয়া বন্ধ করলে জোড় করে পেটের ভিতর খাবার ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারপর শুকরের গলায় একটা লৌহ শলাকা-যা দেখতে অনেকটা তীর'র মত ঢুকিয়ে দিয়ে সরকার নির্ধারিত "জবাই খানা"য় শুকরকে হত্যা করা হয়। রক্ত বিতরণ করা হয় কমুনিটির সকল সদস্যদের মাঝে।
ফুটন্ত গড়ম পানিতে সোডা মিশিয়ে শুকরের শরিরের সমস্ত লোম তুলে পরিস্কার করে আস্ত শুকরকে সামান্য মশলা(মশলা বলতে অনেকখানি রশুণ, ধনিয়া পাতাই মেইন) মেখে তেলের ভিতর চুবিয়ে রাখা হয় ২/৩ ঘন্টা। অর্থাৎ মেওনাইজ করা হয়। রান্না(বেইক)করার জন্য সারিবদ্ধ চুলা আগেই রেডি রাখা থাকে। খোলা চুলার উপড়ে লোহার গ্রীল দেয়া আছে। সেই গ্রীলের উপড় আস্ত শুকর রেখে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পোড়ানো(বার-বী-কিউ) হয়।
পোড়ানোর সময় গন্ধে কাছে থাকা খুবই কস্টকর-কিন্তু চায়নীজরা মহা উতসাহে ওই রন্ধন প্রক্রিয়া দেখে। উল্যেখ্য যে-এখানকার বাবুর্চীরা কিন্তু আমাদের দেশীয় নান্না মিয়া বাবুর্চীদের মত পেট মোটা নয় এবং খালি গায়ে ঘর্মাক্ত হয়ে রান্না করেনা। এরা সুস্বজ্জিত বাবুর্চীর পোষাক পরা থাকে।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সারে পাঁচটার সময় শুরু হলো "মাংস খাওয়া উতসব"। আমরা বিদেশী সম্মানিত মেহমান হিসেবে আমাদের জন্য স্পেশাল আয়োজন।
আমাদের টেবিলে মোট ১২ জন বসেছি। স্যুপ শেষে প্রথমেই দেয়া হয় "জিয়ান বাও" (রাইস পেপার) নামক একধরনের ফিনফিনে পাতলা রুটি। দেখতে অবিকল টিস্যু পেপারের মত। ওগুলো "খাবার"-বলে নাদিলে নতুন যেকেউ ওগুলো টিস্যু পেপার ভাবতে বাধ্য। এবার দেয়া হলো বিশাল আকৃতির প্লেটে সেই পোড়ানো শুকরের মাংশ, মাংসের সাথে শুকরের পেটের ভিতরে "অটোমেটিক" তৈরী হয়ে যাওয়া "স্বব্জি-পোলাউ"ও আমাদের প্লেটে দেয়া হলো।
শুকরের মুখটা হা করা, জিহব্বা ও দাঁতগুলো বিভতস ভাবে বেড়িয়ে আছে। মুখের চামড়া পুড়ে মাঝেমাঝে খশে গিয়েছে। পোড়া চোখ দুটো আমার দিকে মলিন ভাবে তাকিয়ে আছে! আমাদের অনেকগুলো বিয়ারের বোতল ছাড়াও স্থানীয় চোলাই মদ দেয়া হয়েছে খেতে! বিভতস চেহারার শুকর খাবার দেখে সাজিদ অসুস্থ্য হয়ে পরল। আমার অবস্থাও তদ্রুপ! কিন্তু আমি আমার মনের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে সুস্থ্য দেখাতে আপ্রান চেস্টা করছি।
"আমরা শুকর খাইনা"-এই কথা শোনার পর আমাদের টেবিলে বসা কয়েকজন সিনিয়র গ্রামবাসী হতাশা আর আপসোশে হাহাকার করে উঠোলো! ভাবটা এমন যে-শরত চন্দ্র চট্টপধ্যায়ের সেই "নতুন দা" গল্পের শহুরে বাবুর মত-"তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে"! উপস্থিত গন্যমান্য ব্যাক্তিরা জানতে চাইল-কেনো মাংশ খাবনা? রান্না কি খারাপ হয়েছে?-ইত্যাদি।
আমি যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বললাম-আমাদের ইসলাম ধর্মে শুকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। ওরা বললো-তাহলে অল্প করে খাও! আমি অল্পও খেতে না চাইলে বললো-তাহলে তুমি শুধু শুকরের "ব্রেইন স্যুপ" খাও!
আমি যখন জানালাম-আমরা ইসলাম ধর্মের মানুষ...। ডেনিয়েল ছাড়া অন্য কেউ বুঝতেই পারছিলনা-ইসলাম ধর্ম কি? আমি যখন ভাংগা ইংলিশ, ভাংগা চায়নীজ ভাষায় ব্যাখ্যা করছিলাম-তখন ওখানকার চীনা কমুনিস্ট পার্টির নেতা "ঝেং কে"(রাজনীতিবিদ)-যাকে আমি নাম দিয়েছি "বিজ্ঞ লোক"। তিনি একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব এনে বললেন-"আই আন্দারস্তান! আই আন্দারস্তান!! ইউ বুঢা! বুঢা!!"(আই আন্ডারস্টান্ড, ইউ বুড্ডা বুড্ডা। মানে আমি বুঝেছি-তোমরা বুড্ডিস্ট)।
আমি আবার বললাম-না, আমরা বুঢা নই, আমরা "মুসলিম"-মানে "মোহামেডান"......।
যেই "মোহামেডান" শব্দটা উচ্চারন করেছি-অমনি সেই "বিজ্ঞ লোক"টা-চায়নীজ ভাষায় কিযেনো বললেন-আর তাঁর ডান হাতটা নিজের গলার কাছে নিয়ে এক পোচে গলাটা কেটে ফেলার অভিনয় করে সবাইকে দেখালেন! এবার উপস্থিত সকলেই যেনো অনেকটা চমকে গেলেন। স্থানীয় কয়েকজন সিনিয়র লোক আমাদেরকে চোখ বড় করে বিস্ময়ের সাথে দেখতে থাকে......
তখন ডেনিয়েল আর ওর শশুর পরিবারের সকল সদস্য চায়নীজ ভাষায় সকলকে কিযেনো বললেন-তারপর ওরা সবাই অট্টহাসিতে ফেঁটে পরে আমাকে জডিয়ে ধরে বলছিল-"দুই বি কি, দুই বু কি, মেই ওয়া জি, মেই ওয়া জি"(সরি, ডোন্ট মাইন্ড)।
"বিজ্ঞ লোক" হাতের ইশারায় কি বলেছিলেন/বুঝিয়েছিলেন তা আমি যেমন বুঝেছিলাম-নিশ্চই পাঠক আপনারাও বুঝেছেন। তারপরেও ডেনিয়েল আমাকে বুঝিয়ে বললো-ঐ বিজ্ঞ লোকের ধারনা "মুসলমান/মোহামেডান মাত্রেই মানুষ জবাই করে"-সেই কথা শুনেই উপস্থিত সবাই ভয়ে আঁতকে ওঠে!
রাতে শুরু হবে জমকালো নাচ-গানের উতসব।
সাজিদের অসুস্থ্যতার কারনে আমরা সেই মহাউতসব নাদেখেই বেইজিং ফিরে আসার আয়োজন করছি...। আমরা ঐ গ্রাম থেকে ফিরে আসায় সময় এক করুন দৃশ্ব্যের অবতারণা হয়। সকলের চোখে মুখে বেঁদনার ছবি। এই ৮/৯ ঘন্টা সময়ের ভিতরেই আমাদেরকে ওরা খুবই আপন করে নিয়েছে, বিশেষ করে সাজিদকে। সাজিদকে সবাই ভীষন আদর করছে।
গ্রামে এমন কোনো তরুন-তরুণী, যুবক-যুবতী নেই-যারা ওকে সাথে নিয়ে ছবি তুলেনি। সেইসব তরুণ-তরুণীরা, ওদের পিতা-মাতা সবাই আমাদের জন্য নানান প্রকার গিফট দিচ্ছে। অনেক তরুনী মেয়েরা সাজিদকে প্রেমের নিদর্শন সরুপ "লুয়ো হুই"(ফুল),"সি টিয়ে"(চুম্বক), "লিং ডাই"(টাই), "সাউ পা"(রুমাল),"ওয়েজিন"(মাফলার) গিফট দিয়েছে-যা শুধু মাত্র চায়নীজ অবিবাহিতা মেয়েরা তাদের কাংখিত ছেলে বন্ধুকে দেয় (গিফটের এই রহস্যময় বিষয়টা ডেনিয়েল এবং ডেনিয়েল পত্নী জানিয়েছে)! অনেক তরুণী সাজিদের নোট বুকে ওদের নাম ঠিকানা চায়নীজ ভাষায় লিখে দিয়েছে-ওরা সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিল-সাজিদ চায়নীজ ভাষায় লিখতে/পড়তে পারেনা।
মজার বিষয় হলো অনেক তরুণীই সাজিদকে "আই লাভ ইউ" লিখেছে ইংলিশে, এবং হার্ট ফুটো করে তীর বিদ্ধ করা ছবিও এঁকে দিয়েছে-তারপর নিজের নাম ঠিকানা লিখেছে চায়নীজ ভাষায়। তাতে বোঝা গেলো-ওই শব্দটা এবং হার্ট তীর বিদ্ধ সাইনটা এখন দেশে দেশে স্বার্বজনীন! সাজিদ এতো পরিমান গিফট পেয়েছিল-যা অকল্পনীয়।
শিশু কিশোর, তরুন-তরুণীরা কেউ কেউ ভীষন মন খারাপ করছিল। ডেনিয়েল পুত্র ইয়াং শি এবং ওর আম্মু সাজিদকে জড়িয়ে ধরে শতশত লোকের সামনে কান্না করছিল-যাদেখে আমারো চোখ ভিজে গিয়েছিল। সবাই আমাদেরকে হাত নেড়ে বলছিল-""ই লু পিং আন", "ই লু পিং আন"!!(হেপী জার্ণী)।
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।