শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
যুদ্ধিষ্ঠির বলিলেন, হে মহাব্রাহ্মণ, কীরূপে জন্ম তাঁহার, যুবনাশ্বের সেই পুত্রের, ব্যাঘ্রতুল্য সম্রাট যিনি, রাজাদিগের উৎকর্ষ, ত্রিভূবনেই যাঁহার লব্ধ হইয়াছিল সম্যক প্রসিদ্ধি? জানিতে বড় অভিলাষ, অপরিমেয় দীপ্তিময় তিনি, কীরূপে আরোহণ করিয়াছিলেন সর্বোচ্চ রাজকীয় ক্ষমতায়, কেননা ত্রিভূবন তো রহিয়াছিল মহাত্মা বিষ্ণুরও শাসনদণ্ডাধীন?
লোমশ সেই ক্ষণে এই উপাখ্যান ব্যক্ত করিলেন—
বহু, বহু বর্ষকাল পূর্বে, ইক্ষ্বাকু (Ikshvaku) বংশে রাজা ছিলেন যুবনাশ্ব (Yuvanashva), অনন্য পুণ্যাত্মা তিনি, সম্পন্ন করিয়াছিলেন এক সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ, এবং আরো নানাবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান, মহা আড়ম্বরে, প্রচুর দক্ষিণাসহকারে।
পরিতাপের বিষয়, রাজর্ষির ছিল না কোনো পুত্রসন্তান, তাই অমাত্যদিগের উপর রাজ্যভার অর্পণ করিয়া অরণ্যে গমন করিলেন তিনি এবং তথায় পুত্রকামনায় শাস্ত্রানুসন্ধান ও যোগবলসাধনায় নিমগ্ন হইলেন।
শাস্ত্রাচারে উপবাস করিয়া একদা নিশীথে ক্লিষ্ট হইয়া উঠিলেন রাজর্ষি। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাঁহাকে দহন করিতে লাগিল, অন্তরাত্মায় তাঁহার অনুভূত হইল সুতীব্র তৃষ্ণা—চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করিলেন তিনি: তথায় যজ্ঞবেদীর উপর এক কুম্ভ জল রক্ষিত ছিল।
তৃষ্ণার্ত সম্রাট জল কামনা করিলেন, কিন্তু পক্ষীর ন্যায় ক্ষীণ তাঁহার কণ্ঠস্বর কাহারও কর্ণগোচর হইল না। অনন্তর স্বপ্রণোদনায় কুম্ভ উত্তোলন করিয়া জলপান করিলেন তিনি, অবশিষ্ট জল নিক্ষেপ করিলেন ভূতলে। চ্যবন ও অন্যান্য মুনিগণ নিদ্রোত্থিত হইয়া কুম্ভ জলশূন্য দেখিতে পাইলেন এবং উহার তত্ত্বানুসন্ধানে নিয়োজিত হইলেন; যুবনাশ্ব অগ্রসর হইয়া সত্য স্বীকার করিলেন।
"আপনি অনুচিত কার্য করিয়াছেন, হে রাজন্য!" চ্যবন বলিতে লাগিলেন। "আপনকার পুত্রোৎপত্তির নিমিত্তে মন্ত্রঃপূত তপোসিদ্ধ এই জল সংরক্ষিত হইয়াছিল, উহা আপনকার রাজ্ঞীর জন্য অভীষ্ট ছিল।
তপোসাধনা ব্যর্থ হইবার নহে, এই ক্ষণে জলপান করিবার দরুন আপনিই পুত্র প্রসব করিবেন, কিন্তু গর্ভধারণের ক্লেশ যাহাতে আপনাকে আক্রান্ত না করে, আমরা সেই প্রয়াস পাইব। "
শতবর্ষ পূর্ণ হইলে যুবনাশ্বের বাম পার্শ ভেদ করিয়া সূর্যতুল্য এক তেজস্বী পুত্র নির্গত হইল, সুতীব্র দ্যুতিময় শিশু, কিন্তু যুবনাশ্বের মৃত্যু ঘটিল না; নিঃসন্দেহে ইহা অত্যাশ্চার্য এক কাণ্ড বটে!
মহাদ্যুতি শিশুর দর্শনাভিলাষে নক্ষত্রবাসীদিগের আগমন ঘটিল এবং উহারা এই বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন, শিশুর জন্য মাতৃস্তন্যের কী ব্যবস্থা হইবে!"
"মাং ধাস্যতি—আমাকে পান করিবে" বলিয়া ইন্দ্র, যিনি নির্ঘোষ করিয়া থাকেন বজ্র, তাহার মুখে তর্জনী প্রবেশ করাইয়া দিলেন; শিশু তাহা চোষণ করিয়া ব্যাপক বলশালী হইয়া উঠিল এবং ত্রয়োদশ হস্ত পর্যন্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল।
হে ভরতপুত্র, উক্ত দিবসেই আনীত হইল সেই ধনুক, বিশ্বজুড়ে অজগব নামে যাহার প্রসিদ্ধি, এবং শৃঙ্গনির্মিত শরও, এবং অভেদ্য বর্ম। স্বয়ং ইন্দ্র তাঁহাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন; অনন্তর ত্রিভূবন জয় করিলেন তিনি, ন্যায়পথে, একদা ত্রিপদক্ষেপে যাহা সম্পাদন করিয়াছিলেন মহাত্মা বিষ্ণু। বিশ্বজুড়ে তাঁহার রথচক্র অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলমান হইল।
ইহাই সেই কাহিনী, যুবনাশ্বের পুত্র, সসাগরা সদ্বীপা রাজ্যের মার্তণ্ডপ্রতাপ রাজার উপাখ্যান, হে ধর্মপূত্র, মাং ধাস্যতি'র কারণে যাঁহার নাম হইয়াছিল মান্ধাতা। আর শত শত বর্ষ পূর্বেকার, সুপ্রাচীন তাঁহার শাসনকালকে আমরা অভিধা দিয়া থাকি মান্ধাতার আমল।
_________________________________
ইক্ষ্বাকু: আখ-সম্পর্কীয়; প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সভ্যতার ক্ষত্রিয়দের বিখ্যাত বংশ, সূর্যদেবের নামানুসারে যা সূর্যবংশ নামেও পরিচিত। এ বংশের প্রথম সম্রাট ইক্ষ্বাকু, যিনি তাঁর পিতা মনু'র ধর্মশাসন তথা "মনুস্মৃতি" বাস্তবায়ন করেন। দক্ষিণ-এশিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে আখ গাছ থেকে মানুষের উৎপত্তির যে কাহিনী, সেখান থেকেই ইক্ষ্বাকু বংশের নামকরণ বলে অনেকের অভিমত।
ইক্ষ্বাকু বংশেরই পরবর্তী একটি প্রধান শাখা রঘুবংশে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের জন্ম।
কুবলাশ্বর: মান্ধাতার পিতামহ কুবলাশ্বরের শাসনামলে মহাবল, মহাসুর এক দানব ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। বালুকার মধ্যে নিদ্রিত উক্ত দানব বৎসরান্তে যখন নিঃশ্বাস ফেলত, অর্ধপক্ষকাল ভূমিকম্প সৃষ্টি হতো, স্ফুলিঙ্গ, অগ্নিশিখা ও ধূম্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে যেত চতুর্দিক। মহাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্য কুবলাশ্বর একদা তাঁর একুশ সহস্র পুত্র ও সৈন্য নিয়ে অভিযাত্রা করেন। বালুকাবেলায় ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধকাণ্ড সংঘটিত হয় এবং যোগবল ও ব্রহ্মাস্ত্রের সমন্বয়ে একসময় দানবকে হত্যা করতে সমর্থ হন কুবলাশ্বর।
ধুন্ধু নামক এ দানব বধের কারণে কুবলাশ্বর ধুন্ধুমার নামে খ্যাতি লাভ করেন এবং তার অভিযান পরিচিত হয় "ধুন্ধুমার কাণ্ড" নামে।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত মহাভারত অবলম্বনে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।