সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে
এই রাত্রিকালীন মহাসড়কের সাথে আমার সখ্যতা বহুদিনের। স্পেসেফিকলি বলতে গেলে সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই। তখন এমনও দিন গেছে প্রতি সপ্তাহান্তে আমি একবার করে যাতায়াত করেছি এই মহাসড়ক ধরে। তখন আমার অলস দেহ কিংবা সে দেহে ক্লিষ্ট গতি, কোনটাই না থাকলেও গৃহের প্রতি একটা দুর্বার টান ছিল। এখনো যে নেই তা বলা যায় না।
তবে বয়েসের টানে তানপুরার সুর এখন অনেক পাল্টে গেছে। মনে আছে সেদিন গলা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো, যেদিন আমি প্রথম শহর বদল করি। ফেলে আসা শহরটাকে আমি বহুদিন বুক পকেটে নিয়ে ঘুরেছি। নতুন শহরের দালান কোঠায়, মানুষের মুখের রেখায় উপযোজনের অনুপ্রেরণা খুঁজেছি এবং এরপর একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করেছি আমার শার্টে আর কোন বুক পকেট নেই! এ শহরে থাকতে হলে বুক পকেট রাখতে নেই। মূলত: তখন থেকেই আমার ঘরমুখী যাতায়াত গুলো উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলো।
যদিও এই রাত্রিকালীন ভ্রমণের প্রতি আমার আকর্ষণ এখনো সমান দুর্নিবার রয়ে গেছে।
দূর পাল্লার বাসের জানলায় প্রায়শ:ই একটা বৈরাগ্যের সুর লেখা থাকে। আমার পক্ষে এর লোভ সামলানো দায়। তাই জানালার পাশের সিটটার ব্যাপারে আমি বরাবরই আপোষহীন থেকেছি। প্রয়োজনবোধে ঘন্টাখানেক কাউন্টারে কাটিয়ে দিয়েও পচ্ছন্দসই জায়গাটা না পেলে আমি বাসে উঠিনি।
আজও যেমন তার অন্যথা ঘটে নি। একরাশ অন্ধকার আর মৃদু চন্দ্রালোক পাশে রেখে আমি ছুটে চলেছি পরিচিত প্রকান্ড মহাসড়ক ধরে। এসময় বাস জুড়ে থাকা ঘুমের প্রলেপ আমি স্পষ্ট টের পাই। বাসটাকে তখন একটা গহিন ঘুমপুরী মনে হয়। জানলার ফাঁক গলে শীতল বাতাস ঢুকে পড়ে।
বাসের সিটে আমার এলিয়ে দেয়া শরীর জুড়োয়। আইপড্ শাফলের সাথে আমার মুডও শাফলড্ হয়, বিভিন্ন ভাবনারা দল বেঁধে আসে। মুড শাফলড্ হয়েও অবশ্য বেশি দূরে যাওয়ার উপায় থাকে না। কারন ট্র্যাক গুলো খুব যত্ন করে আমারই সিলেক্ট করা। যাত্রাকালীন বৈরাগ্য সাধনে এটা এক অপরিহার্য অনুষঙ্গের মত।
অধিকাংশ সময় ধরে আমি জানলার দিকে তাকিয়ে থাকি। কখনো একটা জঙ্গলের মতন, কখনো ক্ষেত, কখনো সেতু, কখনো একটা থমকে থাকা বিস্তীর্ণ মেঘ আমি পলকে পেরিয়ে যাই। অথচ আমার যে খুব তাড়া এমন নয়। অন্ধকার ফুঁড়ে আসা ছোট ছোট আলো চোখে পড়ে। সাথে ছোট ছোট ছাউনির ঘর, পুকুরের পাড়।
একেকটা দ্বীপের মত বাড়ি। কখনো একটা সরু মেঠো পথ যেন আলগোছে নেমে হঠাৎ হারিয়ে গেলো। পাশে একটা টিনের ছাউনি, বসবার বেঞ্চি। চায়ের দোকান। এবং আরো অস্পষ্ট ঘুমন্ত জনপদ।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ওদের। কোন এক অজানা কারনে আমার কেবলই মনে হতে থাকে এরা পৃথিবীর সবচে' সুখী মানুষের দল। কি আশ্চর্য নৈ:শব্দে ঘুমিয়ে আছে। নাগরিক সব জটিলতা ভুলে কি সাধারন থেকে গেছে। এমন ভাবনা আমাকে প্রায় কাতর করে তোলে।
আমি তখন বাসে বসে বসে অনেক শূন্যতা ভাবি আর কিছু একটা না পাওয়ার বেদনায় ক্রমশ: বিলাসি হই।
"মহাসড়কের সাথে সখ্যতা" ব্যাপারটা আসলে আমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। কারন আমি এর পার্থিব দিক গুলোর ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন থেকেছি। আমার কখনোই জানতে ভালো লাগে নি - বাস এখন কোন এলাকায় চলছে, কিংবা এই জায়গাটার নাম কি? বা সচরাচর অন্য কোন ভৌগলিক বিষয়। আমি এই পথে প্রচুর নদী উপভোগ করেছি সত্যি।
কিন্তু খুব সচেতনভাবে তাদের নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। নদীর উপর জোনাকির মত বিন্দু বিন্দু আলো। নৌকার সংসার। দূরবর্তী জাহাজের আভাস, বালি তোলার ডিঙ্গি আর সেতুর সারি বাঁধা সোডিয়াম আলোয় আমি মেকি রহস্য বুনি। বহু আগে শোনা একটা রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন করে বিভোর হই।
------------------------------------------------------------------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।