ভালোবাসি মানুষকে
বাস মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের কারনে উত্তরাঞ্চলের পরিবহণ সেক্টরে এখনো সামান্যতম নৈরাজ্য কমেনি। এই সংগঠনের একগুঁয়েমি ও দাপটে বি.আর.টি.সি সহ নতুন কোনো বাস বা টেম্পো রাস্তায় নামাতে পারছে না কেউ। সংশ্লিষ্ঠ সুত্র জানায়, কোনো ব্যাক্তি যাতে বাস কিনতে না পারে ও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা না বাড়ে এ জন্য A¯^vfvweK ভাবে চাঁদার অংক বাড়ানো হয়েছে। অনেক জেলায় বাস-মিনিবাস কিনে রাস্তায় নামানো একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, প্রকাশ্যে সাধারণ সভা করে। পাশাপাশি প্রশাসনের সাথে নিবিড় সখ্যতার কারনে সমিতিভূক্ত ফিটনেস বিহীন পুরোনো লক্কর-ঝক্কর গাড়িগুলো বিভিন্ন জনের হাত ঘুরে ফিরে অবাধে রাস্তায় চলাচল করছে।
এসব ৩০/৩৫ বছরের পুরাতন ভাঙ্গা গাড়িই নতুন গাড়ির দামে বিক্রি হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, কোনো উপজেলা সদর থেকে যাতে দূর পাল্লার কোচ না চলে এ জন্য সড়ক অবরোধ ও বাস ধর্মঘটও করা হচ্ছে এদের পক্ষ থেকে। কোন বাসে করে গন্তব্যে যাওয়া হবে - এ সিদ্ধান্ত নেয়ারও এখতিয়ার যেনো যাত্রীদের নেই। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় সড়ক ও মহাসড়কগুলো তৈরী করা হলেও এতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ করছে মালিক নামধারি সংগঠনগুলো।
পরিণত করেছে বাপ-দাদার তালুক মুল্লুকে। এই চক্রের কারনে প্রতিযোগীতাবিহীন এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্থা একেবারেই নিকৃষ্ট পর্য়ায়ে নেমে এসেছে। এদের হাতে জিম্মি ও বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে লাখ লাখ মানুষ।
মর্তে দোযখের অনুভূতি
রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম কিংবা বগুড়া থেকে নওগাঁ, এমন অনেক স্থানীয় রুটে চলাচলকারি বাসগুলোর এখন বেহাল অবস্থা । লক্কর-ঝক্কর এসব ২৫ সিটের মিনিবাসকে ৩২ থেকে ৩৫ সিটে, ২৯ সিটের গাড়িকে ৩৮ সিটের বানানো হয়েছে।
সিটগুলোকে এমন চাপাচাপি ভাবে বসানো হয়েছে যে, বসতে গেলে হাঁটু ভাঁজ করা করা যায় না। একটু j¤^v‡U যাত্রিকে টিকেট কেটেও অবশেষে দাড়িয়েই গন্তব্যে যেতে হয়। কোনো কোনো গাড়ি দীর্ঘদিন মেরামত না করায় সিটের গদি উঠে রেক্সিন ফুঁটো হয়ে গজাল বা পেরেকের সূঁচালো মাথা বের হয়ে এসেছে। বসলে বিশেষ অঙ্গে বিঁধে। আবার পাটাতন ক্ষয়ে যাওয়ায় ভাঙ্গা অংশ দিয়ে রাস্তার ধূলো চলন্ত গাড়ির ভিতরে ঢুকে চৈত্রের ধূলিময় আবহ তৈরী করে।
জানালার কাঁচ নেই। আবার কাঁচ থাকলেও জানালা খোলা যায় না। গাড়িতে চড়লে যাদের বমি করার অভ্যাস তারা অনেক কষ্টে জানালার পাশের সিটের টিকেট কিনে যখন গাড়িতে ওঠেন, গাড়ি চলতে শুরু করলে তখন জানালা খুলতে না পারায় গাড়ির ভিতরেই হর্হর্ করে বমি করে দেন। এই চলতি পথে অবার মাঝে মাঝেই তোলা হয় শুঁটকির বস্তা আর ইলিশ মাছের টুকরি। ছাদ চুঁইয়ে গায়ে এসে পড়ে মাছের পঁচা পানি।
তখন উৎকট গন্ধে এইসব মিনিবাস পরিণত হয় এক চলন্ত হাবিয়া দোজখ্ বা নরকে ।
কুড়িগ্রাম রুটের নিত্য দিনের যাত্রী তৈয়বুর রহমান জানান, দোযখের অনুভূতি নিয়েও যখন যাত্রিরা বাধ্য হয়ে বাসে বসে থাকেন, তখন দেখা গেলো সেই বাসের ব্রেক নেই। গাড়ি থামানোর দরকার হলে চালক গাড়ি গিয়ার বদলিয়ে এক্সিলেটরের চাপ কমিয়ে দেয়। কাশির মতো শব্দে গলা ঝাড়া দিয়ে গাড়ির গতি কমতে থাকে। হেলপার এক টুকরো উঁচু কাঠের ঠেক্ (টুকরো) নিয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে গাড়ির সামনে চলে আসে।
এরপর রাস্তায় সামনের চাকায় কাঠের ঠেক্ বসিয়ে দিয়ে অবশেষে গাড়ি থামায়। যাত্রিদের সে এক প্রচন্ড মানষিক চাপের কাহিনী। মৃত্যু ভয় গোটা শরীরজুড়ে ভর করে। এ সময় অনেকে ভয়ে দোয়া দরুদ পড়তে থাকেন - লা ই লাহা ইন্না আন্তা সোবাহানাকা ...। এভাবে গন্গনে রোদে থেমে থেমে কচ্ছপ গতিতে চলতে চলতে সারা রাস্তায় সেরে নেয়া হয় যাত্রি তোলার কাজ।
হাঁস-মুরগির মতো গাঁদাগাঁদি করে তোলা এইসব যাত্রিরা দুঃসহ গরমে যখন গন্তব্যে পৌঁছেন, তখন তাদের শরীরে ঘুঁষঘুঁষে জ্বর আর বত্রিশ ভাঁজা হওয়ার উপক্রম। এমন অনুভূতির অভিযোগ এ অঞ্চলের প্রতিদিন চলাচলকারী হাজারো যাত্রী সাধারণের।
তবুও বাস কিনতে মানা
বাস ব্যবসাকে কুক্ষিগত করার জন্য বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে এক শাহী ফরমান জারি করেছে। সংশ্লিষ্ঠ প্রশাসনের নিরব সম্মতিতে এই ফরমানের বলে ১৬ জেলায় বাস ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চায় এমন কোনো ব্যাক্তি নতুন কোনো মিনিবাস কিনতে পারবে না। যদি মটর মালিক সমিতির কোনো সদস্যের গাড়ি ওই সমিতির কোনো রুটে না চলে তাহলেই শুধু অন্য কেউ ওই শূন্য হওয়া স্থানে নতুন গাড়ি ঢোকাতে পারবেন।
তা নাহলে সমিতি ভূক্ত কোনো লক্কর-ঝক্কর গাড়ি নতুন গাড়ির দামে কিনে নতুন কোনো ব্যাক্তি সমিতির সদস্য হতে পারবেন। এ আইন শুধু বগুড়া জেলা বাদে উত্তরের সব জেলায় বলবৎ আছে।
বগুড়া মটর মালিক সমিতির কার্যকরী কমিটির এক সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এই জেলায় নতুন গাড়ি রাস্তায় নামাতে সংগঠনের কোনো বাধা নেই এ কথা ঠিক। কিন্তু এমন শর্ত রয়েছে যেগুলো পূরণ করতে হলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। সমিতির নির্ধারিত চাঁদা ছাড়াও বিভিন্ন পদের নেতাদের ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা করে সেলামি, ভালো রুটে গাড়ি নিতে হলে সে ক্ষেত্রে সেলামির অংক সব মিলিয়ে ৪/৫ লাখে গিয়ে পৌঁছুবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন এখানেই শেষ নয়, নেতাদের পরিচিত ও মূখচেনা না হলে কোনো ভাবেই নতুন গাড়ি ঢোকানো সম্ভব হবে না।
রংপুরের বিশিষ্ঠ ব্যাবসায়ি শাহজাহান বাবু জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি মিনিবাস ঢোকানোর জন্য রংপুর মটর মালিক সমিতির সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। কিন্তু গাড়ি ঢোকাতে পারছেন না। সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি পুরোনো কোনো গাড়ি চেইন আউট না হওয়া পর্যন্ত এ সুযোগ তিনি পাবেন না। তারপরও তিনি অপেক্ষা করে আছেন, হয়তো কোনো একদিন সমিতিভূক্ত একটি পুরাতন গাড়ি বয়সের ভারে বিকল হয়ে আর চলতে পারবে না।
সেদিন তিনি একটি নতুন গাড়ি কিনবেন। পেয়ে যাবেন মালিক সমিতি নামের একটি অত্যন্ত ক্ষমতাধর সংগঠনের সদস্য পদ।
কুড়িগ্রাম মটর মালিক সমিতির একজন সদস্য অনুপ বিশ্বাস জানান, সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি প্রায় ৬/৭ বছর ধরে এ জেলায় নতুন কোনো মিনিবাস ঢোকার অনুমতি নেই। এ সমিতির সদস্য হতে গেলে সমিতিভূক্ত পুরাতন গাড়ি কিনে তবেই সদস্য পদ নিতে হবে। এ কারনে নতুন গাড়ির যে দাম, ২৫/৩০ বছরের লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়িরও সেই দাম এখন এই রকম জেলাগুলোতে।
সড়কগুলো কার ?
জনগনের ট্যাক্সের টাকায় সরকার সড়ক ও মহাসড়কগুলো তৈরি করলেও এর উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মালিক সমিতির পুর্ণ নিয়ন্ত্রনে থাকা এসব সড়কে সরকার পরিচালিত বিআরটিসি’র বাসকেও অনেক জায়গায় স্থানীয রুটে চলতে দেয়া হয় না। এর পাশাপাশি এক উপজেলা থেকে আর এক উপজেলায় চলাচল করতে দেয়া হয় না কোনো টেম্পো সার্ভিস।
এদিকে, বি.আর.টি.সির বাস সহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ঢাকা চট্রগ্রাম সহ বিভিন্ন স্থানে চলাচলকারি দূরপাল্লার কোচগুলো যাতে চলাচল করতে না পারে এ জন্য মটর মালিক সমিতিগুলো সড়ক অবরোধ সহ বাস ধর্মঘট করা শুরু করেছে। সমিতির নেতাদের অজুহাত, এ দূরপাল্লার কোচগুলো স্থানীয় রুটের যাত্রীদের পরিবহণ করায় তাদের লোকাল রুটের বাসগুলো যাত্রী পাচ্ছে না।
লোকসান গুনতে হচ্ছে মিনিবাস মালিকদের। আর যাত্রীদের বক্তব্য হচ্ছে, লোকাল রুটের বাসগুলোর সার্ভিস এতই খারাপ যে, ২০ কিলোটিার রাস্তার গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের প্রায় ২ ঘন্টা সময় লেগে যায়। আর দুর পাল্লার কোচে চড়লে ১৫ থেকে ২০ মিনিটে পৌঁছানো যায়। এ কারনে ¯^í সময়ে ও আরামে যাওয়া জন্য তাদের অনেকে দুর পাল্লার কোচে চলাচল করেন।
এদিকে, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী দুরপাল্লার কোচ রাস্তায় থামিয়ে মটর শ্রমিক ও মালিকদের লোকজন স্থানীয় রুটের যাত্রীদের কোচ থেকে নামিয়ে দিচ্ছে।
গায়ের জোরে তাদের লোকাল মিনিবাসে তুলে দেয়া হচ্ছে। এমন অভিযোগ হরদম পাওয়া যাচ্ছে। বাসযাত্রীরা কোন গাড়িতে চড়বেন তার সিদ্ধান্ত নেয়ারও এখতিয়ার যেনো তাদের নেই। যাত্রীদের অভিযোগ, এমন অবস্থা বিরাজ করছে উত্তরের প্রায় সব জেলাগুলোতে।
পরিবহণ মালিক সমিতির বক্তব্য
উত্তরবঙ্গ পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি বেবী ইসলামকে প্রশ্ন করা এ সব বিষয়ে।
নতুন গাড়ি চলাচল করতে না দেয়া প্রসঙ্গে তিনি সমকালকে বলেন, ভটভটি নসিমন-করিমন সহ অবৈধভাবে চলাচলকারি সিএনজি গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায রুটের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ কারনে বিভিন্ন জেলায় হয়তো সমিতিগুলো এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ৩০/৩৫ বছরের পুরোনো ফিটনেস বিহীন গাড়ি কেনো চলাচল করছে এ ব্যাপারে তিনি বলেন, সরকার আইন করুক যে এ ধরনের গাড়ি চলতে দেয়া হবে না তাহলে আমরাও ওইসব গাড়ি চলতে দেবো না। প্রতিযোগিতার এ যুগে নতুন ও অরামদায়ক সার্ভিস কেনো দিচ্ছেনা মিনিবাসগুলো এর জবাব তিনি সরাসরি না দিয়ে বলেন, বেসরকারি বাস চলাচলে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। তবে সার্ভিস উন্নত করা দরকার বলে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করেন।
পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য
উত্তরাঞ্চলের পরিবহণ সেক্টরে নৈরাজ্যের ব্যাপারে এডিশনাল ডি.আই.জি বলেন, নতুন গাড়ি মালিক সংগঠনগুলো রোডে নামাতে দিচ্ছেন না এ বিষয়টি নিয়ে তার কাছে কেউ অভিযোগ করেন নি। যদি মটর মালিক সমিতি গাড়ি নামানো বন্ধ করে থাকে তাহলে তা অবশ্যই অন্যায়। কোনো ব্যাক্তি গাড়ি কেনার পর যদি তার বৈধ লাইসেন্স, রুট পারমিট থেকে থাকে তাহলে গাড়ি নামানোর ব্যাপারে আমরা পূর্ণ সহযোগিতা করবো। নসিমন করিমন ও ভটভটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব একবারেই গ্রামীণ জনপদে চলাচল করে। এদের ক্ষেত্রে আমরা খুব হার্ড লাইনে যাই না।
কারন হিসেবে তিনি বলেন যে এলাকায় গাড়ি চলে না সেইসব এলাকায় ওই পরিবহন বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারণের উপকারে আসছে। ফিটনেস্ বিহীন গাড়ি চলাচল প্রসঙ্গে বলেন, এসব গাড়ি ধরে প্রায়ই আমরা মামলাসহ জরিমানা করে থাকি। তবে প্রয়োজনীয জনবলের অভাবে তা নিয়মিত হয়ে ওঠে না। তিনি আরো বলেন, আইন প্রয়োগ করা যেমন পুলিশের কাজ, তেমনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রাস্তায় ঠিকঠাক গাড়ি চালানো পরিবহন মালিকদেরও কর্তব্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।