আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
পুরনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের পর বাড়ি ফেরার বাস ধরতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো বাসস্টপে । ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে শরীরে , মনে ক্লান্তির কোন কমতি ছিলোনা । অবশেষে প্রায় পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর গন্তব্যের বাস পেয়ে গেলাম । লোকাল বাসে লোকজন ভর্তি ছিলো ।
অনেক কষ্টে প্রবেশ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ । প্রায় ঝুলে থাকবার মতো অবস্থা । সারাদিনের আবহাওয়া অসম্ভব উত্তপ্ত ছিলো । এক অসহনীয় প্যাচপ্যাচে গরমে জেরবার হয়ে ছিলাম বলা চলে । এমন এক অবস্থায় ধস্তাধস্তি করে সামান্য এক অংশে ঝুলে থাকাটা শরীর আর নিতে পারছিলোনা ।
মনে হচ্ছিলো কিছু সময় পর ফেইন্ট হয়ে পড়ে যাবো । তাছাড়া মনও বিশেষ ভালো নেই । পেশাগত উদ্দেশ্যে পুরনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাতটি ফলপ্রসূ হয়নি । তাকে দোষ দেইনা বিশেষ । আমাদের সমাজে যৌথবদ্ধতার সর্বোচ্চো চূড়া হলো স্কুলে বন্ধুর সাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়া পর্যন্ত ।
প্রাপ্তবয়স্ক হলে ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতার চোরাবালিতে ক্রমাগত ডুবতে ডুবতে আমি যৌথবদ্ধতার মধ্যে আছি এমন ভড়ং করে যাওয়া । একশোজনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন হয়তো ফিতা কেটে স্কুল – কলেজ , মাদ্রাসা , হাসপাতাল , বেশ্যাবাড়ী , পার্ক ইত্যাদি উদ্বোধন করে অথবা অঢেল টাকার মালিক হয়ে কাকের আশেপাশে ভাত ছিটানোর মতো করে কিছু টাকা পয়সা ছড়িয়ে সমাজহিতৈষী ব্যক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে । বাকিদের বেলায় লবডংকা । এসব ভেবে ভেবে যখন আরো বেশী দিশেহারা লাগছিলো সেই সময়ে সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে চারপাশের লোকজনদের দিকে তাকাতে আরম্ভ করলাম । একেকজনের প্রবল বিধ্বস্ত চেহারা ।
তাদের প্রায় প্রত্যেকেই জীবনযুদ্ধে পরাজিত বুঝে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়না । তবুও একেকজনের গন্তব্যে পৌঁছাবার আকাঙ্খা দেখছি মন দিয়ে । যেন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেই আরো একটি জীবন পাবে । অথচ রাষ্ট্র , সমাজ স্রেফ পরিবারের মধ্যেই তাদের সকল প্রকারের অধিকার , কর্তব্যের সীমা বেঁধে দিয়েছে । সেই অদৃশ্য দড়ির বাইরে একচুল পরিমাণ নড়বার ক্ষমতা তাদের নেই ।
নিজেদের রক্ত পানি করা পয়সায় বাসে চড়ে বলে বাস ভাড়া দুই টাকা বাড়লেই কন্ডাক্টরকে ক – বর্গীয় , চ – বর্গীয় গালি দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনা ।
এদিকে বাস ঢিমেতালে চলছে । ট্রাফিক জ্যামের কারণে বেশীদূর যেতে পারছেনা একটানে । ঠিক এমনই এক বিরক্তিকর সময়ে দুইজন নতুন যাত্রী বাসে উঠলো । বছর চল্লিশের এক লোক তার সাথে বছর দশ থেকে বারোর এক বালিকা ।
আমি লক্ষ্য করতে আরম্ভ করলাম তাদের দুইজনেই বিশেষত ছোট মেয়েটি বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত । আশেপাশের সবাইকেই খুবই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে । যেন এদের মধ্যেই এমন কেউ আছে যে তাদের সম্ভাব্য ঘাতক হতে পারে । মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালাম । চেহারায় ভয় ছাড়া আর বিশেষ চোখে পড়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হচ্ছেনা ।
শ্যামলা , ছিপছিপে শরীরের । কিন্তু নাকফুলটির দিকে একবার চোখ গেলে তা থেকে আর চোখ সরাতে পারলাম না । এই রাতের সামান্য আলোতে তা অনেক জ্বলজ্বল করছে বলে মনে হচ্ছে । তেমন আহামরি কোন দৃশ্য নয় কিন্তু আমি এই জঘন্য পরিবেশেও মোহমুগ্ধ হয়ে গেলাম । জ্বলজ্বল করা নাকফুলটিকে মনে হলো প্রচন্ড অন্ধকার সময়ের টানেলের শেষ প্রান্তের আলোর মতো ।
যেই আলো দিনের শেষে সকল মরীচিকাকে পরাজিত করে স্বীয় নিয়মে উদ্ভাসিত হয়ে মনে ক্রমশ বসন্তের পাতা ঝরাতে থাকে । এদিকে বাস নিজের নিয়মে ঢিমেতালে চলতে থাকে । আমি আমার জীবনের বাস্তবতা ভুলে তাকিয়ে থাকি বালিকার নাকফুলটির দিকে । জ্বলজ্বল করা নাকফুল । তবে সে যেন টের না পায় সেই কারণে সাবধানে সময় মতো তাকাচ্ছি ।
তার নাকফুলের দিকে আমার নির্ণিমেষ দৃষ্টি টের পেলে সে আরো বেশী আড়ষ্ট হবে এই বিষয়ে ততক্ষণে নিশ্চিত হয়েছি । এদিকে মেয়েটির সাথের লোক খুব সম্ভবত তার বাবা ঘনঘন নিজের কম দামী সস্তা ঘড়িতে চোখ রাখছে । সেই অস্থিরতা আমার চোখ এড়ালোনা ।
অবশেষে আমার গন্তব্য চলে আসে । আমি জায়গা থেকে ঠিকভাবে পা বাড়াতে না বাড়াতেই হুড়মুড় করে সেই বালিকা আর তার বাবা বাস থেকে নেমে গেলো ।
বাস থেকে নেমে আমি আমার বাস্তবে ফিরে আসলাম । বড্ড নিরানন্দের সেই বাস্তব । মরুভূমির অসহনীয় উষ্ণতাসম এক সাধারণ নাগরিকের অসহনীয় বাস্তব যেখানে সকল আশা-আনন্দ দিনের শেষে অধরা থেকে যায় । সামনে কিছুদূর যেতে এক খালি রিকশা দেখতেই ভাড়া ঠিক করে তাতে উঠে বসলাম । এতোটাই ক্লান্ত লাগছে যে অল্প কিছু পথ সেটাও চলতে পারবোনা ।
অবশেষে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে মেটাতে কিছু দূরে দুইজনের কথোপকথন কানে আসলো । একজন বলছে “ স্যার মাইয়াটারে অনেক কইছি , অনেক বুঝাইছি কিন্তু বুঝবার চায়নাই , অনেক ডরাইতেছে । বুঝেনই তো প্রথমবার , বয়সই বা আর কতো ? “ অপরজন রুঢ় কন্ঠে বলে উঠলো “ না না এসব তালবাহানা চলবেনা , বিদেশ থেকে তিনজন সাহেব এসেছে আগেই বলছিলাম না তোকে ? কত পয়সাওয়ালা তারা জানিস ? মাসে এরকম দুই থেকে তিনটা ট্রিপ মারতে পারলে তোকে আর তোর মেয়েটাকে পায় কে চিন্তা করে দেখেছিস ? না না তোর সাথে আর কথা বাড়াতে পারবোনা । তারা তিনজন আসছে , তোর মেয়েটার তাদের সবাইকেই আজ রাতে একসাথে নিতে হবে । “ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাদের দিকে তাকাতেই দেখি বাসের সেই ভীত-আড়ষ্ট পিতা-কন্যাকে ।
কন্যার নাকে সেই নাকফুলটি এখনো জ্বলজ্বল করছে । কেবল হারিয়ে গেলো আমার সেই সময়কার মোহমুগ্ধতা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।