আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উৎকণ্ঠা আমার মায়ের নাম



উৎকণ্ঠা আমার মায়ের নাম আরও একটি দেশ আছে। আমি যেন ভুলে যাই সেই দেশের কথা। সেই দেশ কোথায়? কোন দেশের পাশে সেই দেশ? সেই দেশে কারা বাস করে? সেই দেশের নদীর নাম কী? ফুলের নাম কী? সেই দেশে কারা থাকে_ এ প্রশ্ন মনে আসতেই ফের মনে পড়ল, সেই দেশে কারা থাকে না? সেই দেশের জাতীয় দুঃখের নাম কী? সেই দেশে সাধারণ মানুষের ঘুম হয় কেমন? সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত কী, কে তার রচয়িতা? কে সুর করে গায় সেই গান? সেই দেশে কি সত্যি সত্যি ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়ে যায়? খুব ভালো করে কি বলতে পারব সেই দেশের মানচিত্রটা কেমন? অনেকটাই ভুলে থাকি, যে দেশের কথা বলছি, সেই দেশ তাহলে কেমন? সে দেশে কি ব্যাংক আছে? ব্যবসা আছে? অ্যাডফার্ম, কনজ্যুমার, টিভি-রেডিও-পত্রিকা গণমাধ্যম আছে? সেই দেশের কি সীমানা আছে? সীমান্তরক্ষী বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে? সেই দেশ কি বাংলাদেশের মতোই আরেকটি দেশ? সেই দেশে সমুদ্র আছে ক'টা? সেই দেশে কি পাখি ওড়ে, পাখিদের নাম কী? সেই দেশে কি ভাষা আছে, থাকলে ভাষারই বা নাম কী? সে ভাষায় কবিতা লেখা হয়? হলে, সে কবিতা পড়ে কেউ? সেই দেশে কি ছবি আঁকা হয়, হলে কেমন দেখতে সেই ছবি? সেই দেশে কি স্বপ্ন উড়ে যায়, শিশুতোষ ঘুড়িদের মতো? সেই দেশের আকাশে কেমন মেঘ, ডাকে আমাদের? সেই দেশে কি দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন আছে? বিস্ময়বোধ আছে? জ্ঞাত-জিজ্ঞাসা আছে? অজ্ঞাত-জিজ্ঞাসা আছে? কী এমন দেশ যে, সেই দেশকে দেশই মনে হয় না? কী সেই দেশের নাম, বলো? সেই দেশে কি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বাজার বাড়ানোর জন্য খেলাধুলা-বিনোদন হয়? ফুটবল ক্রিকেট হয়, যা কিনা একটা সমাজের মৌলিক স্তরে কোনো কাজেই লাগে না? খাদ্য-স্বাস্থ্য চাহিদায় কোনো স্পন্সর না থাকলেও, কোটি কোটি লোককে একটি বল ও একটি ব্যাটের দিকে নিবদ্ধ করে বসিয়ে রাখার এই কোম্পানি স্পন্সরড খেলা মানুষের মৌলিক বিস্তৃতিতে কী ভূমিকা রাখে? তবে, এ রচনায় আজ ওদিকে যাব না, আরেকদিন যাব। আজ আমরা কথা বলব একটি দেশ নিয়ে। অবশ্যই বাংলাদেশ নয়, আজ কথা বলব সেই দেশ নিয়ে।

সেই দেশ কোন দেশ, ভূগোলে কোথায় অবস্থিত কিংবা সে দেশের ডাকনাম কী? আমি একটি দেশের রাজধানী শহরে থাকি, বহু বছর। আমার বাড়ি এই শহর থেকে আড়াইশো কিলো দূরে। আমাদের বাড়ির মানুষ তাই সবসময় আড়াইশো কিলো দূরের মানুষ। প্রথম প্রথম চিঠি লিখতাম বাড়িতে, বাড়ি থেকেও চিঠি আসত আমার ঠিকানায়। থাকতাম বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে।

ছাত্রজীবন শেষ করে যথারীতি নাগরিক ('ভাড়াইট্টা' বলে পুরনো ঢাকার মানুষ)। তো, আমি সেই দেশের কথা বলে, সকালবেলায় এত এত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে এখন একান্ত পারিবারিক কথা তুলছি কেন? এই কেনও এক প্রশ্ন। তা ছাড়া ফুটবল-ক্রিকেটের মতো এত পপুলার বৃহত্তর মানুষের পছন্দনীয় খেলাধুলা নিয়ে সকালবেলায় এমন বেফাঁস মন্তব্যও তো মানা মুশকিল_ বিশেষ করে একবার ভেবে দেখার দরকার আছে_ কত কোটি টাকা ঢালা হচ্ছে কত কোটি টাকা তুলবার বাণিজ্যে, ফুটবল-ক্রিকেটের পেছনে-মধ্যে-সামনেও। 'জানো, একজন অলরাউন্ডার মানে কী? দরিদ্র-নিপীড়িত-অশিক্ষিত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন-মূর্খ-দুর্নীতিপরায়ণতার শীর্ষে অবস্থানকারী একটি দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড় র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ অলরাউন্ডার, বোঝো এটা কত বড় গৌরবের ব্যাপার? 'কী করেন একজন অলরাউন্ডার?' 'বলকে ব্যাটের দিকে ছুড়ে মারেন, আবার নিজেও ব্যাট নিয়ে বলে বাড়ি দেন। ' 'ওহ।

বিরাট ব্যাপার। তাইলে দেশ এত সংকটে কেন?' 'সে তো রাজনীতিবিদদের জন্য। ' 'ওহ। রাজনীতিও কি একটা খেলাধুলা না? রাজনীতিতে কী ব্যাটসম্যান, বোলার, অলরাউন্ডার থাকে না?' গ্যালারিতে মানুষ থাকে না, কোটি কোটি? ২. দেশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। উৎকণ্ঠা আমার দেশ।

উৎকণ্ঠা আমার মায়ের নাম। উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়েই আমরা বড় হয়ে উঠেছি। উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়েই বড় হচ্ছে আজকের শিশু। ফলে বলতেই পারি, আমি উৎকণ্ঠার নাগরিক। উৎকণ্ঠা আমার মা।

আড়াইশো কিলোমিটার দূরে বসে আমার মা উৎকণ্ঠায় আছেন, 'সন্তান ভালো আছে তো?' দুরাগত একটি ধ্বনি ক্রমশই নিকটে চলে আসে। ধ্বনিটা কানের মধ্যে ঢুকতেই টের পাওয়া যায়_ অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সের হুঁইসেল কানে আসে ক্রমশই। উৎকণ্ঠা বাড়ে। আমার মা উৎকণ্ঠায় থাকেন।

উৎকণ্ঠার দেশে অ্যাম্বুলেন্সের হুঁইসেলই জাতীয় সঙ্গীত। আতঙ্কই প্রধান উৎসব। অসহায়ত্বই শ্রেষ্ঠ বিনোদন। সেই সঙ্গীতে আছি, সেই উৎসবে আছি, সেই বিনোদনে আছি। তাই বলছিলাম, জাতিসংঘ কি সেই দেশকে সদস্য দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে_ যে দেশের নাম উৎকণ্ঠা? যে দেশের মানুষের কিছুই করার থাকবে না, দুর্বৃত্তরাই দেশপ্রেমিকের উপাধি লাগিয়ে মহড়া দিয়ে বেড়াবে প্রতিদিন রাস্তায় অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে_ সেই দেশের নাম কী? ইতিহাসের পিরামিড মাথায় করে বয়ে বেড়াবে মানুষ, সাধারণ মানুষ! কিছু মানুষ ইতিহাসের পিরামিড হয়ে 'অসাধারণ' হয়ে উঠবে, মিউজিয়ামের খাট-পালঙ্ক, ঢাল-তলোয়ার হয়ে উঠবে আর দর্শক হিসেবে থাকবে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ।

তারা টিকিট কেটে মিউজিয়ামে ঢুকবে! এই দর্শনচর্চার নাম কী? নিশ্চয়ই তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি! নিশ্চয়ই তারা প্রাণিকুলকে দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। নিশ্চয়ই তারা দেশে দেশে আর্য, বাকিরা অনার্য। আর্যরা শাসন করবে বলে, বলল, 'শোনো, আমরা আদেশপ্রাপ্ত। আদেশ দিয়েছেন ঈশ্বর। ঈশ্বর বলেছেন, তোমাদের যেন আমরা দেখভাল করে রাখি, উন্নয়নে কাজে লাগাই।

তোমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরাই সবকিছু ঠিকঠাক করে দেব। তোমাদের কী লাগবে, কী লাগবে না, তা আমরা জানি, সেই অনুযায়ী আইন করে দেব। তোমরা আইনের শাসন মেনে চলবা। না মানলে কারাগারে বন্দি করে রাখব ইহকালে। পরকাল সম্পর্কেও তো একটা ধারণা দিয়ে রেখেছি, পুরোহিতরা নিশ্চয়ই সেসব বলেছেন নানান সভায়, অসভায়।

তাই, আমগোরে তোমরা ট্যাক্স দিবা। তোমাদের ট্যাক্সেই তোমাদের চালাব, আমরাও চলব। তোমরা চলবা তোমাদের মতো, জনসাধারণের মতো, যেহেতু তোমরা প্রজা, তোমরা নাগরিক, তোমরা রাজ্যের অধিবাসী। আমরা চলব আমাদের মতো। আমরা ঈশ্বরের আদেশপ্রাপ্ত, আমরা আর্য, আমরা ব্রাহ্মণ, পুরোহিত।

আমাদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির লড়াই থাকতে পারে, তবে এ নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তোমরা চতুষ্পদদের মতো চলিবেক। আমরা তোমাদের হিতসাধনের নিমিত্তে কত কিছুরই না পরিকল্পনা করেছি। একটার পর একটা কল্পনা সময়মতো বের করে ছেড়ে দেব তোমাদের উদ্দেশে। হলো তো? দাবি মিটিয়ে দিলাম তো! তোমাদের জন্য আমরা সর্বদাই এমন ব্যস্ত যে, একটু রেস্ট নেওয়ার সময়ও হাতে থাকে না।

ফলে, ঈশ্বরপ্রাপ্তদের আনাগোনা বিস্তৃতি লাভ করে। কেন্দ্র থেকে পাড়াগাঁ পর্যন্ত সেই আনাগোনার দাপট দেখা যায়। মাঝেমধ্যে ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকানদের দ্বন্দ্ব জনগণের সামনে চলে আসে। এটাই হচ্ছে প্রধান বিনোদন, বানিয়ে রাখা বিনোদন। 'নে, বিনোদন খা।

' ফলে, সেই বিনোদনই আমাকে নিয়ে যায় উৎকণ্ঠার দেশে। উৎকণ্ঠা আমার মা। আমার মতো কোটি কোটি মানুষের মায়ের নাম উৎকণ্ঠা। আমরা উৎকণ্ঠায় থাকি। আমাদের মায়েরা উৎকণ্ঠায় থাকেন।

'সন্তান, ভালো আছে তো?' দূর থেকে ফোনে কথা হয়। মায়ের কতখানি আর্ত-আহ্বান_ 'বাবা, তুই বাইরে যাসনে। চারদিকে যে খারাপ অবস্থা। গুলি ফুটছে, বোমা ফুটছে। ' মায়ের উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

সেই মা দ্যাখেন, কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা। সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা। ডালের বড়ি শুকিয়ে উঠছে। খোকা ফিরবে। কিন্তু খোকা তো ফিরল না।

একদিন যুদ্ধে গেল ছেলেটা। একদিন স্কুল থেকে আর ফিরে এল না মেয়েটা। একটা ছেলেকে পাওয়া গেল হাসপাতালে, একটা মেয়েকে পাওয়া গেল লাশকাটা ঘরে। একটা ছেলেকে আর পাওয়াই গেল না। কত ছেলেই যে হারিয়ে গেল।

কত মেয়েই যে নিরুদ্দেশ। তাহলে, মায়ের উৎকণ্ঠা না হয়ে পারে? অসুখের পাশাপাশি বাবার উদ্বেগ না বেড়ে পারে? ভাইবোন-প্রিয়জনদের ব্যাকুলতা কি কোনোভাবেই কমে? কেন কমে না? 'যেমন খুশি তেমন সাজো'র মতো 'যেমন পারো তেমন করো' খেলা চলছে। বহুজাতিক কোম্পানি তাদের অফিস বসিয়েছে, কারখানা খুলেছে। কেন? ভোক্তাদের জন্য। ভোক্তা কারা? আমরা।

দেশীয় লুটেরা ডাকাতরা ব্রিটিশের রেখে যাওয়া কোট-প্যান্ট পরে ভদ্রলোক সেজে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। একটা সুবিধাবাদী শ্রেণী গোটা দেশকেই তাদের 'লুটযোগ্য মাল' হিসেবে দেখছে। মোটা দাগে, একটা 'শিক্ষিত' শ্রেণী শাসন করে চলেছে লেখ্য ভাষায় 'অশিক্ষিত'দের। চলছে। ইতিহাস মাথায় করে বালকেরা স্কুলের বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে।

কেননা তারা 'শিক্ষিত' হচ্ছে। রবীন্দ্র চর্চা-মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মুনাফা লাভ কিম্বা থিয়েটার কালচারাল অ্যাক্টিভিটিস একাকার হয়ে চলছে। লালনতত্ত্ব-এনজিও এবং বাংলার ভাব-আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। মার্কস-মাওলানা পাশাপাশি বসে শরবত খাচ্ছে। আর উদ্বেগ বাড়ছে।

কর্তৃত্বের লড়াইয়ে সাধারণের বলিদান বাড়ছে। চিরকালের মতোই, রাজায় রাজায় যুদ্ধ করছে, ময়দানে মরছে পিপল। ফলে, মায়েদের উৎকণ্ঠা বাড়ছেই। বাবা-ভাইবোন-স্ত্রী-পুত্রকন্যা-পরিজনেরা অসহায় হয়ে ফোন করছে, 'সাবধানে থাকিস। ' আমরা তো ঈশ্বরবিরোধী নই।

ঈশ্বরের প্রতিনিধিদেরও আমরা অস্বীকার করবার সামর্থ্য রাখি না। 'আমরা তো সামান্য লোক, আমাদের পান্তা ভাতে, লবণের ব্যবস্থা হোক' এইটুকুই। ওহে ঈশ্বরপুত্ররা (যিশুর বোন নেই), একবার তাকিয়ে দ্যাখো, বেঁচে থাকবার লড়াইয়ে আসন্ন ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে, বর্তমানের মধ্যে বসে দেশে দেশে কী পরিবর্তনই না হয়ে চলেছে, তোমরাও কিছু পরিবর্তিত হও। শোধিত হও। ঔপনিবেশিক শাসনভঙ্গি থেকে বেরিয়ে বর্ধিত হও।

তারপরই না হয় বলো, 'আমরা আর্যপুত্র, এসেছি ঐশীগ্রন্থ হাতে, তোমরা ঠিকঠাক মেষ পালন করিয়া চলো। ' আমরা চলিব। আমরা মেষ হতে না পারলেও গরুছাগল হতে পারব। কিন্তু 'চিরকাল রাজার লোকেরা কৃষকের ফলানো ধান কেটে নিয়ে যায়'-তেমনটি করো না। ন্যায়নীতির পরাকাষ্ঠার নামে মধ্যযুগ এনো না।

আমাদের বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা আর বাড়িও না। এই যে বলছি 'বাড়িও না'_ এর মধ্যেই একটা অনুরোধ বিদ্যমান। অর্থাৎ আমরা তোমাদের কর্তৃত্বকে মেনে নিয়েছি। উপায় কী! মায়ের নাম উৎকণ্ঠা, বলেছি। কিন্তু, আমাদের মতো সাধারণেরও কী ইচ্ছে করে না, আমাদের মা হোক উৎফুল্ল? মা হোক হাসিময়।

বাবা হোক নিঃশব্দে গর্বিত! ভাইবোন-প্রিয়জন হোক আনন্দিত। বলেছি, মা-বাবা থেকে বহুদূর, আমি থাকি আড়াইশো কিলো দূরে। আমার মায়ের নাম উৎকণ্ঠা। উৎকণ্ঠা আমার দেশ। আমাদের মা-বাবাকে উৎফুল্ল হতে দেবে না? হ কালের খেয়া, সমকাল, ১.১১.২০১৩


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.