এই দেশ, এই প্রকৃতি ও খুব কাছের মানুষ ছেড়ে কোথাও মিলিয়ে যাবো একদিন, সে সব কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয়। মানুষের কাছে, প্রকৃতির কাছে আমি ঋণী। সেসব ঋণ শোধ করা হবে না কোনদিনই। তবু যেতেই হবে। যেতে হয়।
আমার প্রতিদিনের ভাবনা এবং জীবনের কিছু কথা যাবার আগে বলে যেতে চাই দেশের স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার মরণপণ সংগ্রামে যেসব মুক্তিযোদ্ধা স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম এবং ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজ পতাকার জন্য আমরা গর্বিত। গর্বিত স্বাধীন একটি ভূখন্ড অর্জনের জন্য। আর যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই অহংকার, ইতিহাস তাদের কতটুকু প্রাপ্য দিতে পেরেছে, সে অনেক বিতর্কের বিষয়। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিরদিন এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
তাঁরা অমর হয়ে থাকবেন প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির অন্তরে।
‘থাক ওরা পরে থাক ইতিহাস নিয়ে/জীবনের দীনতা হীনতা নিয়ে/ তোমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভিড়ে...’। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের কিংবদন্তী খান আতাউর রহমানের লেখা এই গানটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের এই ভিন্নমাত্রাই সঠিক। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যে মূল্যায়ন করেছেন তার চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না।
ইতিহাসে ঠাঁই হয়নি, কিন্তু লাখো মানুষের অন্তরে ঠাঁই পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জানি আমি।
তিনি মজিবুল হক মজনু। আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ মজনু ভাই দক্ষিণ জনপদের থানা রায়েনদা (বর্তমানে আসাদনগর)-এর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকাররা অকুতোভয় এই সৈনিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো একাত্তরের ডিসেম্বরে। সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিনের কথা মনে করে মজনু ভাই বলেন, ‘যে আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পর স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তার মূল্য অপরিসীম।
আগামী প্রজন্ম এ দেশের লাল-সবুজ পতাকার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ’
’৭১ সালে আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র ছিলাম। জানুয়ারি থেকেই আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরটিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। প্রায় প্রতিদিনই স্কুল ধর্মঘট।
মিছিল-মিটিং। নিজের ভেতর যেন কেমন একটা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। মিছিলে অংশ নিয়ে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিতাম। মিছিলে যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই আমার বড় ভাই। আমার আজও মনে পড়ে তাদের কথা।
তাদের মধ্যে অন্যতম মজনু ভাই, দুলাল ভাই, লুৎফর ভাইসহ আরো অনেকের পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। এতোসব বড় ভাইদের মধ্যে মজনু ভাই কেন জানি আমার অন্তরের সবটুকু দখল করে নিয়েছিলেন। ছোটবেলা বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ পোস্টারের প্রতি আমার সাংঘাতিক ধরনের দুর্বলতা ছিলো। সত্তরের নির্বাচনে মজনু ভাইর কাছ থেকে অনেকেই চেয়ে চেয়ে পোস্টার নিচ্ছিলো। আমি কারও কাছে কোনদিনই কিছু চাইতে পারিনি, আজও না।
সেদিন মজনু ভাই আমাকে দু’টি পোস্টার দিয়েছিলেন না চাইতেই। সেই থেকে লোকটাকে কেমন যেন ভালো লেগে যায় আমার। সেদিন থেকে তার মধ্যে এক ধরনের সরলতা আর দেশপ্রেম দেখে নিজেকে তার মতো করে তৈরি করার কথা ভাবতাম। মোটামুটি তার আদর্শ আজ আমারও মধ্যে বিস্তারলাভ করেছে বুঝতে পারি।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন কর্মকান্ডে মজনু ভাই দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিতে ঢুকে পড়েছিলেন। মজনু ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মাস্টার্স করার পরও তিনি কোন চাকরি করেননি। করেননি কোন ব্যবসাও। ওসব যেন ধাতে সইতো না তার । তিনি দেশ গড়ার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।
এ কারণে মজনু ভাইর আর্থিক দৈন্যতা ছিলো। অনেক সময় সিগারেট কেনার পয়সাও থাকতো না তার পকেটে । এতে তার কোন আক্ষেপ ছিলো না। একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়েছি। বাড়িতে মজনু ভাইকে পেলাম। রাতে তিনি আমাদের বাসায় থেকে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে বেশী পছন্দ করতেন। রাত দশটা হলে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার নিউজ শুনতেন। প্রতিদিন ডায়েরী লিখতেন।
কী কী লিখেছেন আমাকে পড়ে শোনাতেন। এতো চমৎকার করে ডায়েরী লিখতে কাউকে দেখিনি কখনও। যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, একদিন আমি আমার ব্রিফসের পকেটে হাতরাচ্ছি। মজনু ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খুঁজছো?’ আমি জানালাম যে, কয়েকটি খুচরা টাকা ছিলো পকেটে। মজনু ভাই হেসে বললেন, ‘পাবি কী করে? আমি সবগুলো নিয়ে সিগারেট কিনেছি।
’ মজনু ভাই আমার টাকা দিয়ে সিগারেট কিনেছেন শুনে আমি এতো আনন্দ পেয়েছিলাম, যা আজও আমাকে শিহরিত করে। কী অপূর্ব সরলতায় মজনু ভাই যে কাজটি সেদিন করতে পেরেছিলেন, তা আর কারও পক্ষে সম্ভব বলে মনে করি না। একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যিনি ইচ্ছে করলে লাখ লাখ টাকার মালিক হতে পারতেন, তিনি তা না করে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে খুচরো পয়সা নিয়ে সিগারেট কিনেছেন- এ যেন ভাবনার অতীত! সে কথাগুলো মনে করে আজও রোমাঞ্চিত হই আমি। শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে যায় মজনু ভাইয়ের সরলতা ও উদারতার কাছে!
অনেক অনেক স্মৃতি আছে মজনু ভাইকে নিয়ে। সেসব বলতে গেলে লেখার কলেবর বাড়বে।
একদিনের কথা বলি- আমি সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। হলে তখনও থাকার ব্যবস্থা হয়নি। বাধ্য হয়ে মোহাম্মদপুরের বড় ভাইয়ের মেসে থাকতাম। সেখানে মজনু ভাই প্রতিদিন আসতেন। একদিন আমার ছোটবেলার বন্ধু ফিরোজ ও আমি চা খাওয়ার জন্য কম করে হলেও দু টাকার অভাব অনুভব করছিলাম।
এর মধ্যে দেখলাম মজনু ভাইকে। তাকে বললাম, টাকা দরকার। তিনি তার পকেট হাতড়ে পাঁচ টাকার একটি নোট বের করে দিয়ে বললেন, ‘পাঁচ টাকাই আছে। এখান থেকে দুই টাকা রাখ, বাকী তিন টাকা আমাকে দে। ’ ছোট ভাইদের জন্য এই ত্যাগ আমার স্মৃতিতে আজও অমলিন হয়ে রয়েছে।
মজনু ভাই আমাকে একদিন জহুরুল হক হলে নিয়ে গেলেন। সেখানে দোতলায় সিঁড়ির পাশে বাথরুমের সঙ্গে ২১৮ নম্বর রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন। জহুরুল হক হলের এই রুমটিতে অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত লোক ছাত্র অবস্থায় কাটিয়েছেন। মজনু ভাই সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুইও একদিন তাদের মতো বিখ্যাত হবি। ’ মজনু ভাইয়ের সে কথা খাটেনি।
আমি বিখ্যাত কেউ হতে পারিনি। তবে স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমার খ্যাতি আছে। আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর অধ্যাপক আসাদুল হক সে কথা স্বীকার করেন।
কিছু কিছু ভালোবাসা বোধ হয় রক্ত সম্পর্ককেও হার মানিয়ে দেয়। সে রকম ভালোবাসা মজনু ভাই জন্য আজো অনুভব করি।
মনে আছে, মজনু ভাই তাস খেলতেন আমার ভাইয়া, আনোয়ার ভাই, লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে। তারা দু’টাকা-একটা দিয়ে তিন তাস খেলতেন মোহাম্মদপুর মেসে বসে। ভাইয়া তখন বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করেন। লুৎফর ভাই পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কাজ করতেন। মজুন ভাই ও আনোয়ার ভাই তখনও বেকার।
আমি পাশে বসে তাদের খেলা দেখতাম। খেলায় মজনু ভাই হেরে গেলে খুব কষ্ট পেতাম। মনে মনে বলতাম, ‘আল্লা তুমি মজনু ভাইকে জিতিয়ে দাও!’ অথচ আমার ভাইয়ার কী হলো না হলো সে দিকটায় আমার কোন খেয়াল ছিলো না। কেন এমন হয়! এমন হতে পারে- আজও ভেবে পাই না।
মজনু ভাইয়ের চেয়ে কম শিক্ষিত, রাজনীতি কম বোঝেন- এমন কি খারাপ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকরা মজনু ভাইকে বোকা বলে পরিহাস করতো।
হয়তো আজো করে। আমি তাদের ওপর বিরক্ত। না হবার তো কোন কারণ থাকতে পারে না, স্বাধীনতা যুদ্ধের এই অকুতোভয় মানুষটি যে আমার হৃদয়ের সবটুকু দখল করে আছেন!
মজনু ভাইর সব সরলতা, সব বোকামি একটুকুও ঠকাতে পারেনি তাকে। আল্লা তার সহায় হয়েছেন। যাঁরা তাকে সমালোচনা করতেন আজ তাদের ছাড়িয়ে মজনু ভাই অনেক অনেক ভালো আছেন- সে রকমই আছেন।
বহু বছর পর মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করে তার সঙ্গে কথা বলে সে রকমই মনে হলো। তিনি জানালেন, তার দু’টি ছেলেমেয়ে। মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, ছেলে যুক্তরাজ্যের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছে। আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর মজনু ভাই বললেন, একদিন তোর অফিসে এসে চা খেয়ে যাবো। আমার বলার আগেই তিনি বললেন, আমার অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন! এ রকম কথা শুধু আমার প্রিয় মজনু ভাইর পক্ষেই বলা সম্ভব, অন্য কারও পক্ষে নয়।
১০ ডিসেম্বর, ২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।