আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অখ্যাত আমার বিখ্যাত শিক্ষকেরা - ৪

আগের পর্ব - Click This Link আই ইজ দা হেড মাস্টার ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম বেগমগঞ্জ সরকারী কারিগরী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এক বছর পড়েছি সে স্কুলে। অন্য স্কুলের সাথে সেটার মূল পার্থক্য ছিলো লোহার কাজ ও কাঠের কাজ নামে দুটি বাড়তি বিষয় ছিলো। ওয়ার্কশপে ব্যবহারিক ক্লাসও করতে হতো। ব্যবহারিক খাতায় ছবি এঁকে জমা দিতে হতো।

স্কুলের স্যারদের মধ্যে শুধু এক জনের কথা মনে আছে। আর মনে আছে হেড স্যারের চেহারা, কিন্তু নাম মনে নেই। তিনি ক্লাসে আসতেন না। রাশভারী লোক ছিলেন। তবে রাগতে দেখিনি কখনো।

বিশেষ একটা কারণে তাঁর কথা মনে আছে। ১৯৭৫ সালে আমি ওই স্কুলে সিক্সে ভর্তি হই। একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি স্কুলের সামনে রক্ষীবাহিনীর প্রচুর লোক। গাড়ী, অস্ত্র সব সাথে। শুনলাম আমাদের বিশাল স্কুলের ( তিন তলা ভবন ও তিন তলা হোস্টেল) খালি অংশে রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প হবে।

স্কুলের গেটের বামে হেড স্যারের দেয়াল ঘেরা বাসা। তার পাশ দিয়ে আমরা স্কুলে ঢুকতাম। সেদিন দেখি হেড স্যার মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর স্ত্রী কন্যা আর পুত্র পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। স্যারের বাসার মালপত্র রক্ষী বাহিনীর গাড়িতে তোলা হচ্ছে।

আমরা দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে রক্ষী বাহিনীর লোকজন আমাদের ধমকে তাড়িয়ে দিলো। পরে শুনলাম স্যারকে বদলী করা হয়েছে। হেড স্যারের চার্জ পেয়েছেন হাসানুজ্জামান স্যার। এই একজন স্যারের কথাই মনে আছে। স্যার ছিলেন হাসিখুশী মানুষ।

খুব ভালো শিক্ষক হিসাবে স্যারের সুনাম ছিলো। রক্ষা বাহিনীর ধমক খেয়ে আমরা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঠের দৃশ্য দেখছিলাম। হাসানুজ্জামান স্যারও শুকনা মুখে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সাথে আরো দুতিন জন স্যার। এর মধ্যে বুটেরর খট খট শব্দে আমরা তটস্থ হয়ে উঠলাম।

রক্ষী বাহিনীর একজন অফিসার এলেন। সাথে অস্ত্র হাতে বেশ কয়েক জন সৈনিক। বাজখাঁই গলায় অফিসার জানতে চাইলেন-'' হু ইজ দা হেড মাস্টার ?" হাসানুজ্জামান স্যার কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিলেন - '' আই ইজ দা হেড মাস্টার''। ভয়ে স্যারের মাথা থেকে ব্যকরণ হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তখন সেই ভুলের জন্যহাসি আসেনি আমাদের মুখেও।

পরের বছর ওই স্কুল ছেড়ে দেয়ায় স্যারের আর কোন খবর জানা ছিলো না। ২০০৩ সালে খবর পেলাম হবিগঞ্জের মাধবপুরের গহীন গ্রামে অবস্থিত গোবিন্দপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে হাসানুজ্জামান স্যার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যথারীতি ভালো শিক্ষক হিসাবে ওখানেও স্যারের খ্যাতি ছড়িয়েছিলো। বেগমগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল (এখন সরকারী ) ১৯৭৬ সালে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম বেগমগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে। এ স্কুলে বেশ কিছু নামকরা শিক্ষক ছিলেন।

হেডমাস্টার হিসাবে সুলতান মাহমুদ স্যারের কিংবদন্তী আমরা শুনেছি। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এ স্কুল থেকেই ১৯৮০ সালে এসএসসি পাশ করি। হেড স্যার (মো:আবদুল লতিফ) সুলতান মাহমুদ স্যারের পর মো: আবদুল লতিফ স্যার প্রধান শিক্ষক হিসাবে আসেন। তিনি এর আগে ছিলেন প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

তাঁর সম্পর্কে বলা হতো সেই কালে নোয়াখালী জেলায় তাঁর মতো ভালো আর কোন ইংরেজী শিক্ষক ছিলো না। তিনি নাইন টেনে ইংরেজী পড়াতেন। তবে প্রধান শিক্ষক হিসাবে ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। ক্লাস শুরু হলে স্কুলের বিশাল মাঠে মাছি ওড়ারও সাধ্য ছিলো না। খুব মোটা দুতিনটি বেত হেডস্যারের টেবিলে শোভা পেতো।

স্যারের রুমে কারো ডাক পড়লে ভয়ে অজ্ঞান হবার দশা হতো। দুষ্টু ছেলেদের স্কুল মাঠের মাঝখানে নিয়ে মোটা বেত দিয়ে রাম ধোলাই দেবার বিষয়ে হেড স্যারের খ্যাতি ছিলো আকাশ চুম্বি। স্যারের মার খেয়ে অনেক পাজি ছেলে স্যুঁইয়ের মতো সোজা হয়ে গেছে না হয় স্কুল ছেড়ে চলে গেছে। স্যার আমাদের ওয়াইজ মেন অব দা ওল্ড, আলেক্সান্ডার পোপের কবিতা হ্যাপি দা ম্যান আর আরেকটি কবিতা আলেক্সান্ডার শেলকার্ক পড়াতেন। যার প্রথম লাইন ছিলো- আই এম দা মোনার্ক অব অল আই সার্ভে।

টাকা বা সম্পদ কোন কিছুই যে একাকীত্বকে জয় করার জন্য যথেশ্ট নয় এই বিষয়টি স্যার দারুন ভাবে পড়াতেন। স্যারকে মনে হতো সক্রেটিসের মতো। সেই স্যারকেই একবার আবেগাক্রান্ত হতে দেখেছিলাম। ক্লাস টেনে আমাদের স্কুল জীবনের শেষ ক্লাস। হেড স্যার এসে আমার চুলের পেছনদিকে চেপে ধরলেন।

আমি তো অবাক। স্যার খুব ভেজা গলায় বললেন, এখন তোরা স্বাধীন হয়ে গেলি। কলেজে কেউ লম্বা চুল রাখার জন্য কিংবা যাচ্ছেতাই পোষাকের জন্য কিছু বলবে না। তার মানে বুঝিস ? তার মানে হলো কেউ তোদের খোঁজ খবরই নেবে না। বলে স্যার চোখ মুছলেন।

আমাদেরও চোখের পানি এসে গেলো। সেদিন রাতে আমি আর ঘুমাতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি আর এ স্কুলে কোন দিন ক্লাস করতে আসবো না। স্যার এখন বেঁচে নেই। স্যারের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

(চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.