এখন আমি জীবন নৌকার ভাটার পথের যাত্রী। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত আমার পরিচিতি। আক্ষরিক অর্থেই আমি পনের কোটির একজন মানুষ-নিতান্তই অখ্যাত।
কিন্তু আমার বিরল সৌভাগ্য আমি কিছু বিখ্যাত শিক্ষকের নগন্য ছাত্র ছিলাম। জীবনে দু'বেলা দু'মুঠো ভাত যে জোটে তার কৃতিত্ব মা বাবা আর আমার অসাধারণ সে সব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের।
এবার বিখ্যাত বলতে আমি কি বোঝাতে চাই সেটা বলি। সাধারণভাবে মিডিয়ার কল্যাণে কোন কাজের জন্য বা লেখালেখির জন্য পরিচিত লোকদের আমরা বিখ্যাত বলে বিবেচনা করি। এই অর্থেও কিছু বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন আমার। আর ভালো ও ন্যায়বান শিক্ষক হিসাবে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে বিস্তৃত এলাকায় খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন এমন কিছু বিখ্যাত শিক্ষকেরও আমি ছাত্র হবার গৌরব লাভ করেছি।
আমি এই দুই প্রকার বিখ্যাত শিক্ষকের কথাই নিবেদন করবো।
এটা আমার তরফ থেকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের উদ্যেশে নিবেদিত ''গুরু দক্ষিণা''। কারণ সমাজের অবহেলায় এই সব নিবেদিত দেশ সেবকরা কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের হারিয়ে যেতে দেয়া কি সমীচীন হবে ?
বজল মাস্টর ওরফে মো: বজলুর রহমান
আমার গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের ডাকসাইটে প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো: বজলুর রহমান। সবার কাছে তিনি বজল মাস্টর বলে পরিচিত ছিলেন। নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলার ( সাবেক সদর উপজেলা।
আমাদের সেই কালে বলা হতো সুধারাম থানা) করমবক্স সরকারী ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে (তখন এই নামই ছিলো) দীর্ঘ দিন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমি সেখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই ১৯৭০ সালে। স্যার ১৯৮৩ সালে অবসর নেন। তখন আমরা সাবেক ছাত্ররা মিলে বিশাল আকারে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছিলাম স্যারকে। তিনি মারা যান বছর সাতেক আগে।
তাঁর ব্যক্তিত্ব আর সততার সামনে সবাই নতমস্তক ছিলেন। তাঁর মেজাজের সামনে ছাত্র ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরাও কুঁকড়ে থাকতেন। এমনিতে ছিলেন সদালাপী। ক্লাসে খুব দারুন পড়াতেন। বাড়ী গিয়ে খুব বেশী পড়তে হতো না।
এমনিতে ভালো। কিন্তু রাগলে খবর ছিলো। তখনকার দিনে দুষ্ট ছাত্র খুব বেশী ছিলো না। কিন্তু তাদের পিঠের ওপর দিয়ে বেতের তুফান বইয়ে দিতেন তিনি। সেই ভয়ে বাকীরা তটস্হ থাকতাম।
বড়ো হবার পরও তাঁকে আমরা আগের মতোই ভয় পেতাম। এখন বুঝি এরকম সৎ, নিষ্ঠাবান আর ভালো শিক্ষক বিশেষ করে এমন ব্যক্তিত্ববান প্রধান শিক্ষক এখন বিরল।
তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
নোয়া স্যার ওরফে মো: নূরুল হুদা
মো: নূরুল হুদা স্যার ১৯৭০ সালের কোন এক সময় আমাদের স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। নতুনকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলে ''নোয়া''।
তিনি আমাদের কাছে হয়ে গেলেন ''নোয়া স্যার''। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আমাদের স্কুলে চাকুরী করে ২০০৫ সালে অবসর নেন। এখনো বেঁচে আছেন। সেই যে আমরা তাঁকে ''নোয়া স্যার'' ডাকতে শুরু করেছি আজো তিনি সবার কাছে ''নোয়া স্যার''। আর পুরনো হতে পারলেন না।
স্কুলের সামনে একটা ওষুধের দোকান আছে স্যারের। তখনো ছিলো। সকালে এসে দোকানে বসতেন। স্কুলের সময় হলে স্কুলে আসতেন। আবার বিকালে স্কুল ছুটির পর দোকান খুলতেন।
এখনো সকাল বিকাল দোকানে বসেন। গ্রামের বাজারের দোকান খোলার এটাই রুটিন। এই ঈদে বাড়ী গিয়েও স্যারের সাথে দেখা করে এসেছি।
নোয়া স্যার ছিলেন শিক্ষক হিসাবে দারুন। ক্লসেই পড়া বুঝিয়ে মুখস্ত করিয়ে দিতেন।
বাড়ী গিয়ে প্রায় না পড়লেও চলতো। কখনো কোন ছাত্র ছাত্রীকে পেটানো তো দূরের কথা ধমক পর্যন্ত দিতেন না। সদাহাস্য মানুষ। এখনো। তাই সবাই নির্ভয়ে তাঁর কাছে যেতে পারতাম।
বড়ো হয়ে স্যারের সাথে কথা বলে জেনেছি, গ্রামের অভিভাকবরা ছেলে মেয়েদের বাড়ীতে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারতেন না বলে তিনি ক্লসেই সেটা সেরে দিতেন।
এমন সুবিবেচক শিক্ষক কি একটি সমাজের মূল্যবান সম্পদ নন ?
তাঁকে আমরা ভয় পেতাম না। কিন্তু সমীহ করতাম। এখনো সমীহ করি। শ্রদ্ধা করি।
সকলের অন্তর থেকে পাওয়া শ্রদ্ধাই প্রকৃত শ্রদ্ধা।
স্যার দীর্ঘজীবী হোন। এ দোয়া করি।
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।