আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (৩৪)


৮ এপ্রিল ২০১০। নাস্তা-টাস্তা করে বের হলাম দুপুরে। আজ একটু গরম লাগছে। তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেল ৩টার দিকে হোয়াইট চ্যাপেল রোডে পত্রিকা কিনছি।

হঠাৎ ‘রশীদ ভাই কেমন আছেন’ বলে এসে জড়িয়ে ধরলো সিলেট শেখঘাটের ছেলে রুমেল। তার সাথে ১০/১২ জন বাঙালি। বেশিরভাগই ছাত্র। সে নিজেও গেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। ভর্তি হয়েছে গিলহল কলেজে।

আলাপ করলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। দু’জনেরই তাড়া থাকায় মোবাইল নাম্বার বিনিময় করে চলে আসলাম। চলে গেলাম ব্রিটেনে বাংলা বই’র সবচে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী দোকান সঙ্গিতা লিমিটেড এ। পেয়ে গেলাম প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহানুর মিয়াকে। তিনি একজন বই বিক্রেতা কাম প্রকাশকও।

আমি আমার সর্বশেষ প্রকাশিত দু’টি বই গিফট করলাম তাকে। আমার সাথে তার কোনো পূর্ব পরিচয় ছিলো না। বই দু’টি হাতে নিয়ে বললেন, আপনার লেখা? জ্বি। তার মানে আপনি একজন লেখক? এই আর কি। টুকটাক... তিনি দ্বিতীয়বার হ্যান্ডশেক করে বললেন, কংগ্রাচুলেশন্স।

কবে এসেছেন? এই তো দু’সপ্তাহ হলো। আছি আরো দু’সপ্তাহ। আমি তাকে ১১ তারিখের প্রোগ্রামের দাওয়াত করলাম। তিনি বললেন, অবশ্যই আসবো। তারপর বললেন, আমার এখানে বিক্রির জন্য কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন।

আমি বললাম, প্রোগ্রামের পরে পাঠাবো। তিনি তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। আমার কার্ড রাখলেন। সঙ্গিতা থেকে বেরিয়ে প্রবেশ করলাম মিরা প্লাসে। আরো একটি বই প্লাস অফিস ষ্টেশনারীর বড় দোকান।

মিরা প্লাসের মালিক জনাব রফিকুল হক। তবে খোকন নামেই বেশি পরিচিত। ষাটোর্ধ খোকন আংকেলের সাথে পরিচয় হবার পর অনেক্ষণ বসিয়ে রেখে গল্প গোজব করলেন। তিনি অনেক পুরনো ব্যবসায়ী। সঙ্গিতা এক সময় উনার ছিলো।

বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তারপর অনেক ব্যবসা করে আবারো বই’র জগতে ফিরে এসেছেন। বই’র সাথে সম্পর্ক ছাড়তে পারেন নি। বর্তমানে সিলেটের জিন্দাবাজারে যে জায়গায় কোয়ালিটি রেস্টুরেন্ট, ঠিক সেখানেই উনার একটি বই এর দোকান ছিলো এক সময়। মিরা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম ফেইথ ডিজাইন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স-এ।

এখানে আছেন সাংবাদিক তাইসির মাহমুদ ভাই’র ছোটভাই আব্দুর রহিম। রহিম ভাই ব্যানার তৈরি করছেন। ডিজিটাল ব্যানার। আমি গিয়ে পরিচয় দিলাম। রহিম ভাই অনেক খাতির যতœ করলেন।

চা-টা খাওয়ালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবেশ করলেন মুসলেহ ভাই। তিনি ব্যানারের কালার ও ডিজাইনের ব্যাপারে ইন্সট্রাকশন দিলেন। সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেছে। বাসায় ফিরলাম।

দু’দিন হয়ে গেছে গোছল করা হয়নি। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটা গোছল দিলাম। শরীর ফুরফুরে লাগছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন তাজুল ভাই। সাথে ইউসুফও।

বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন, মারকাজে যাবো। আমি বললাম, কিসের মারকাজ? তিনি বললেন, তাবলিগের। ঢাকার কাকরাইল এবং সিলেটের খোজারখলা ছাড়া আর কোনো মরকাজের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। ভেতরে কৌতূহল বেড়ে গেলো। ব্রিটেনেও তাহলে তাবলিগের মরকাজ আছে।

মাগরিবের নামাজ গিয়ে আদায় করলাম ওয়েস্ট হাম মারকাজে। সেখানে গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ? বিশাল এরিয়া। মাঠে শত শত গাড়ি পার্ক করা। একটি নন মুসলিম ডেমোক্রেট কান্ট্রিতে এ কী অবস্থা? মরকাজের ভেতরে ৫/৭ হাজার মুসলমান। রীতিমত কাকরাইলকে হারমানানো ব্যাপার।

বাদ মাগরিব মসজিদের মূল মিম্বর থেকে আরবিতে বয়ান শুরু হলো। সেখান থেকেই হিন্দিতে অনুবাদও হতে লাগলো। বিশাল বারান্দায় অন্য আরেক জামাত। এরা ইংলিশ। আরবি-হিন্দি বুঝে না।

তাদেরকে মূল বয়ান ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে দেয়া হচ্ছে। অনুবাদক মাওলানা কানে এয়ারফোন লাগিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকেন। মূল আরবি বক্তার বয়ান শুনেন। তারপর তিনি যখন বিরতী দেন, তখন ভেতরে শুরু হয় হিন্দি তরজমা। আর বাইরে ইংরেজি।

মহিলাদের জন্যও রয়েছে বয়ান শোনার পৃথক ব্যবস্থা। বয়ান চললো এশার আগ পর্যন্ত। এশার নামাজের ১৫/২০ মিনিট আগে বিরতি। দেখা হলো ১৫/২০ জন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বন্ধবের সাথে। দেখা হলো আশরাফ, আব্দুল কাহির, আজিজুর রহমান, সাহাদ আহমদ, আব্দুর রহমান, মাওঃ নাজির উদ্দিন সহ অনেকের সাথে।

আরো অনেকের সাথেই দেখা হলো। কথাও হলো। তবে তাদের নাম জানা হয় নি। হঠাৎ সামনে এসে হাত মিলিয়ে অনেকেই বললেন, রশীদ ভাই কেমন আছেন? কবে আসলেন। আমি হাসি দিয়ে বলেছি, ভাল।

তাদের অনেকের চেহারার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিলো। তবে নাম ভুলেগেছি। আর তারা যেভাবে এসে ‘রশীদ ভাই কেমন আছেন’ বলছেন, তাতে তো আর বলা যায় না, ভাল আছি, তারপর, কিছু মনে করবেন না জনাব, আপনার পরিচয়? এশার নামাজ আদায় হলো। নামাজের পর শুরু হলো গণ-আহার। একেকজন মুসলমান ১০/১৫ জনের খাবার নিয়ে এসেছেন।

যে যেখানে খুশি বসছে, যার খাবার থেকে খুশি খাচ্ছে। আমরাও খেতে বসলাম। অমৃতের মতো মনে হলো খাবারের স্বাদ। তৃপ্তি করে খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। রাত সাড়ে ১০টা বাজে।

সাড়ে এগারটায় মুফতী আব্দুল মুনতাকিম সাহেবের সাথে নির্ধারিত বৈঠকের কথা রয়েছে। অতএব হাতে পাক্কা এক ঘন্টা সময়। চললাম তাজুল ভাই’র বাসার দিকে। আপাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া হলো চা’র পানি বসাতে। বাসায় গিয়ে চা খেলাম।

নাশিতা ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। তাকে জাগিয়ে তোলা হল। তার সাথে আমার ৫ দিন পর দেখা। সে আমার কাছে দু’টো চিঠি দিয়ে রেখেছিলো বাংলাদেশে ফিরে তার নানুজীকে দেয়ার জন্য। আমাকে দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, মামা তুমি আমার আর সায়মার চিঠি পৌঁছে দিয়েছো? আমি বললাম, মা মনি, আমি বাংলাদেশে যাইনি তো এখনো।

দেশে গিয়ে অবশ্যই দেবো। সে বললো, ঠিক আছে। অবশ্য ঠিক আছে বলেনি, বলেছে ও-কে। ওরা বেশিরভাগ শব্দই ইংরেজিতে বলে। তারপর আমার কাছে এসে সে তার শিশু সূলভ বিবেক খাটিয়ে প্রমাণ করতে চাইলো এই ক’দিনে আমার প্রতি তার ভালবাসা কমে যায় নি।

কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো, মামা, তোমার নাম আমার মনে আছে। রছিদ জামিল মামা। আমার নামের এই অভিনববত্বের পেছনের ইতিহাস হলো, প্রথম দিন সে আমাকে বলেছিলো, আমি নাশিতা ইসলাম নওরীন। তুমি? আমি রশীদ জামীল। সে বললো, আমার থ্রি নেইম, তোমার টু।

ভাবলাম আমি হেরে যাচ্ছি। আমার নাম ছোট, এটা তো কাজের কথা না। বললাম, আমার নিকনেম তো আছে আরেকটি। তোমাকে বলা হয় নি। সে বললো, সেটা কি? আমি বললাম মামা, পুরো নাম রশীদ জামীল মামা।

তার সমান হলাম। বাসায় চা খেলাম। তারপর জনমত পত্রিকায় দু’টো আর্টিক্যাল মেইল করে চলে গেলাম ইষ্ট লন্ডন বো এলাকায়, মাওঃ মুফতী আব্দুল মুনতাকিম সাহেবের বাসায়। মাওলানা আব্দুল মুনতাকিম হচ্ছেন একুশ শতকের চোখ কান খোলা একজন আলেম। যুক্তরাজ্যস্থ ইব্রাহিম কলেজের শরীয়াহ কনসালটেন্সির পাশাপাশি কাজ করেন টিভি মিডিয়ায়।

ইকরা টিভির নিয়মিত স্পীকার তিনি। দীর্ঘদিন প্রোগ্রাম করেছেন চ্যানেল ‘এস’ এ। জাতীয় সিরাত কমিটি লন্ডন এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফোরাম ইউকে’র ইনফরমেশন সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছেন। এই মাসখানেক আগে, আমি সেখানে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। দেশে অবস্থানকালীন সময়ে তার সাথে দু’টি প্রোগ্রামে আমারও পার্টিসিপেট করার সুযোগ হয়েছিলো।

একটি সিলেট হোটেল হেরিটেজে, ভারতের প্রখ্যাত আলেম সালমান নদভীর সাথে মতবিনিময় সভায়। অন্যটি বন্ধু রুহুল আমিন নগরীর উদ্যোগে মিডিয়া ও ইসলাম শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে, হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনালে। আব্দুল মুনতাকিম সাহেবের বাসায় চা খেতে খেতে তাজুল ভাই আমার শান বর্ণনা করতে শুরু করলেন। প্রমাণ করতে চাইলেন আমি মস্তবড় একজন লেখক। উনার নাম রশীদ জামীল।

উনি ... মুফতী সাহেব বললেন, আর বলতে হবে না। তিনি তার বুক সেলফে হাত বাড়িয়ে আমার দু’টি বই বের করে আনলেন। বললেন, বই দু’টি পড়ে দেশে আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি। আসার আগ মুহুর্তে পত্রিকায় দেখলাম আপনি যুক্তরাজ্য সফর করছেন। এখানে এসে আপনাকে যোগাযোগের কোনো নাম্বার পাচ্ছিলাম না।

আমি খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন, আসলে আপনার মতো... এরপর তিনি আমার সম্পর্কে এমন কিছু কথা বললেন, এককথায় আমি যেগুলোর যোগ্য নই। উলোবনে মুক্তো ছড়ালেন তিনি। রাত সাড়ে ১১টায় বসেছিলাম। আড্ডা চললো রাত ২টা পর্যন্ত। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, উলামায়ে কেরামের নিষ্ক্রিয়তা, প্রসঙ্গে।

তিনি চারটা ভাত খাওয়াবার জন্য জোরাজুরি করলেন। যেহেতু আমরা মারকাজে টাইট হয়ে খেয়ে নিয়েছি, সেজন্য আরো একদিন গিয়ে খাওয়ার ওয়াদা করে ফিরে আসলাম। আজ অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, পরে আর সময়ের অভাবে ভাত খাওয়ার ওয়াদাটি রক্ষা করে আসতে পারি নি। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৩টা বেজে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা বেডে চলে গেলাম।

আপাতত ঘুমের আমল করাটাই সবচে জরুরী। ...ক্রমশ
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।