আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (১)



হেড লাইট কিছু কথা থাকে নিজের, একান্তই নিজের। যেগুলো ঘটাকরে বলে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। ব্যক্তিগত আলো-আঁধারীর সাম্রাজ্যে অন্যকে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার কী? আমার মতে, ব্যক্তিগত সফরের খুঁটিনাটি নিজের জন্যে যা-ই হোক, অন্যের জন্যে অর্থহীন ব্যাপার। এগুলোকে সাহিত্যের কোনো সংজ্ঞায়ই ফেলা যাবে না, তবুও মানুষ সফরনামা লেখে। বিখ্যাত লেখক এডগার এলেন পো’কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ভাল লেখক হতে হলে কী লাগে? তিনি জবাব দিলেন, একটি বড় ডাষ্টবিন লাগে।

‘লেখা’ নামক যে আবর্জনা তৈরি হবে, সেগুলো ফেলে দেবার জন্যে। এলান পো’র কথাকে সত্য ধরে নিলে লেখকরা কিন্তু আবর্জনাই তৈরি করেন বেশি। যেগুলোর উপযুক্ত ঠিকানা ডাস্টবিন। আর লেখা যদি হয় আমার মতো আনাড়ি লেখকের, তা-ও ব্যক্তিগত প্যাঁচালী, তাহলে যে বস্তু তৈরি হবে, সেটা ডাস্টবিনে নয়, চলমান কোনো নর্দমায় ফেলে দেয়া উচিৎ। অবশ্য বাংলাদেশে মুক্ত নর্দমা খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।

আমাদের আওয়ামীলীগ-বিএনপি’র ভাইজানদের দখলে গিয়ে আজকাল ছড়া ও নর্দমাগুলোর উপরে রীতিমত ইণ্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠেছে। কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধানই ভানে। এটি একটি কথার কথা। স্বর্গে ধান-চালের তো কোনো কারবার নেই। ধান ভানার সুযোগ কোথায়? অবশ্য রূপক অর্থে ঢেঁকির ধান ভানার ব্যাপারটি হজম করে নিলে বলা যায় লেখকদের মাঝে ঢেঁকির স্বভাবটি ভালভাবেই আছে।

তারা যেখানেই যান, যাই দেখেন, চেষ্টা করেন লিখে ফেলতে। তাদের পকেটে পয়সা থাকুক আর না-ই থাকুক, কাগজ কলম থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নাকি বাথরুমে ঢুকতেও কাগজ কলম পকেটে রাখতেন। বলাতো যায় না হঠাৎ যদি মাথায় কোনো কবিতার ছন্দ এসে যায়! পরে সেটাতো মনে না-ও থাকতে পারে। গত ২১শে মার্চ ২০১০ থেকে ২৪শে এপ্রিল ২০১০ পর্যন্ত মাসখানেক সময় আমি কাটিয়ে এলাম বাঙালির স্বপ্নরাজ্য বিলেতে।

এই এক মাস মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি আমি লন্ডন শহরের অলিগলি, যেটুকু ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ছিলো আমার। খুলে দিয়েছি কৌতূহলের সবক’টি জানালা। আমি দেখেছি ব্রিটিশ কালচারের ভয়াবহ রূপ। দেখেছি বাঙালি কমিউনিটির হাল-হকিকত। খুব কাছে থেকেই দেখেছি আমি হাজারো বাঙালির দুর্দশা।

আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো স্বপ্নের হাতছানিতে পতঙ্গের মতো সাড়া দিয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় সদ্য পাড়িজমানো ছেলে-মেয়েগুলো। অনেকের সাথেই কথা বলেছি আমি। অনুতাপের আগুনে দগ্ধ অই ছেলে-মেয়েগুলো ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়েছে। তাদের স্বপ্নভাঙ্গার নির্মম শব্দও শুনেছি আমি। যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে সবচে বড় যে সহযোগিতাটি তাদের দরকার, আমি সেটিই করতাম।

পৃথিবীর সবগুলো বিমান ভাড়া করে আমার অই ভাই-বোনগুলোকে নিয়ে এসে ফিরিয়ে দিতাম তাদের মায়ের কোলে। এক মাস সফরের যেটুকুন টুকিটাকি ডায়রীর পাতায় করে সাথে নিয়ে এসেছিলাম, ইচ্ছে ছিলো একটু রয়ে-সয়ে সময় নিয়ে লিখবো। কিন্তু আমার প্রকাশক সময় দিতে রাজি নন। বিলেতের হাওয়া বইয়ের প্রকাশক ফজলু ভাই এর বাড়ী সিলেটের বালাগঞ্জে। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন সেই ১৯৭৭ সাল থেকে।

একজন সফল ব্যবসায়ী। যুক্তরাজ্যে বাঙালি কমিউনিটির জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ফজলু ভাই’র সবচে’ বড় পরিচয় তিনি একজন সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি। বাংলা ও বাঙালির জন্য এর আগেও তার অনেক প্রকাশনা আছে। ২০০৪ সালে প্রকাশ করেছেন ‘প্রবাসে বালাগঞ্জবাসী’ নামক ৪০০ পৃষ্ঠার একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।

অত্যন্ত তথ্যবহুল এই বইটি সম্পাদনা করেছেন প্রয়াত সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ মহিউদ্দিন শিরু। আজকের এই পরিসরে আমরা শিরু ভাইয়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে পারি। ফজলু ভাই’র সাথে আমার পরিচয় মাত্র এক সপ্তাহের। তাজুল ভাইয়ের সৌজন্যে চারটি বই পড়েছেন আমার। তিনি যখন জানলেন আমার বিলেত সফর কেন্দ্রিক বইটি খুব শিগগীরই তৈরি হয়ে যাবে, তখন তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বইটি প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।

সাথে সাথে এ-ও জানালেন, বইটি যেন অবশ্যই ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়। বিলেত জুড়ে বইটি তিনি পৌছে দিতে চান। তাজুল ভাই’র কথা কয়েকবার এসেছে। আরো অনেকবার আসবে। নামটি আলোচনায় এসে যাবে বারবার।

সুতরাং পাঠকের সাথে নামটির একটু পরিচিতি দরকার। তাজুল ভাই মানে খতিব তাজুল ইসলাম। এক দশক থেকে স্থায়ীভাবে বসতি গেড়েছেন যুক্তরাজ্যে। অনেকগুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের চালিকাশক্তি তিনি। আমার সাথে তাঁর পরিচয় মাত্র চার-পাঁচ বছরের।

লেখালেখির মাধ্যমেই পরিচয়। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণেই ২০০৭ সালে গঠিত হয় বৃহত্তর সিলেটের বলিষ্ঠ সামাজিক সংগঠন নাগরিক অধিকার আন্দোলন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সভাপতির দায়ভার তার উপরই ন্যস্ত হয়। তাৎক্ষণিক সময়ে যোগ্য কোনো বিকল্প না থাকায় সাধারণ সম্পাদক’র দায়িত্ব আমার ঘাড়েই বর্তায়। সেই থেকে তাজুল ভাই’র সাথে যোগাযোগ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

সিলেটের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে নিয়ে অনেকগুলো প্রোগ্রামও করি আমরা। ২০০৮ সালে প্রকাশিত আমার ‘নষ্ট রাজনীতি’ বই’র প্রথম সংস্করণের প্রকাশক তিনি। তাঁর নাগরিক প্রকাশনী থেকে বইটি প্রথম বের হয়। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় সিলেট বাপ্পী প্রকাশনী থেকে। তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ঢাকার নূর কাসেম পাবলিশার্স।

একই বছরে একটি বইয়ের তিনটি সংস্করণ বের হওয়া আমার মতো চুনোপুটি লেখকের জন্য বিশাল ব্যাপার। তাজুল ভাই’র অন্যতম আরো একটি পরিচয় হচ্ছে উঁচুমানের একজন লেখক তিনি। অত্যন্ত ধারালো একটি কলম রয়েছে তাঁর। আমি যখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে লেখালেখি শুরু করেছি মাত্র, তখন তাজুল ভাই’র বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। তার লেখা ‘বিনাশী সভ্যতা’ কাব্য গ্রন্থটি পাঠ করলে শরীরে অন্যরকম শিহরণ জাগে।

তবে বিচিত্র কোনো কারণে বেশ ক’বছর ধরে তিনি তার কলমটির মুখে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। এই ক’দিন আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি তার ঘুমন্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে। লন্ডন ভিত্তিক বাংলা পত্রিকা ইউরো বাংলায় লিখেছি আমি। জোর করে তাকে দিয়েও কলাম লিখিয়েছি। আসার সময় বলে এসেছি, প্লিজ তাজুল ভাই, কলমটি সচল রাখুন-প্লিজ।

তাজুল ভাই’র সাথে আমার আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক শুধু আত্মার। তবুও নিছক আমার লেখালেখির কারণে আমার প্রতি তার যে মমত্ব তৈরি হয়েছে, সেই সুবাধেই তিনি আমাকে যুক্তরাজ্যে আমন্ত্রণ জানান। নিজে স্পন্সর করেন। নিজ বাসায় রাখেন এবং নিজের কাজকর্ম ফেলে গাড়ি করে ঘুরে বেড়ান আমাকে নিয়ে।

আমাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতার মত গো-বেচারা ধরণের শব্দ দিয়ে তো সেটার জবাব দেয়া যাবে না। ভূমিকাটা বিশাল হয়ে গেছে। প্রথমে শুরু করার সময় শিরোনাম ‘ভূমিকা’ই ছিলো। ভূমিকা শেষ করে দেখা গেল অনেক লম্বা হয়ে গেছে।

পাল্টে দিলাম শিরোনাম। নতুন শিরোনাম হলো ‘হেড লাইট’। সফরনামার আবার ভূমিকা কী? পুরোটাই তো একটা ভূমিকা। অথবা ফালতু প্যাঁচাল, বেহুদা বক্ওয়াস। খুড়িয়ে চলা গরুর গাড়ির মতো।

তাও প্রশ্ন থেকে যায়, গরুর গাড়ির আবার হেড লাইট কী? হেড লাইট এজন্য যে, বইটিতে উল্লিখিত কিছু কথার অনেক অন্ধকার দিক থাকবে। একটা হেডলাইট থাকলে সুবিধা। শুরুতেই জানিয়ে রাখছি, আমার এই বই কোনো গবেষণামূলক গ্রন্থ নয়। ঐতিহাসিক প্রামাণ্য কোনো দলিলও নয়। একান্ত নিজস্ব অনুভূতি।

এক মাসের নির্মোহ অভজারভেশন ও চিন্তা সমষ্টি। আমার অনেক ধারণা বা সিদ্ধান্ত সঠিক না-ও হতে পারে। আবার কিছু কিছু দৃশ্য এমনও চোখে পড়েছে, কিছু কিছু সংবাদ এমনও কানে এসেছে, আন্তরিকভাবে নিজেই চেয়েছি এটি যেন সত্যি না হয়। বইটিতে যথাসম্ভব ইংরেজিকে এভয়েড করতে চেষ্টা করা হয়েছে তিন কারণে, ১। শতভাগ পাঠক ইংরেজি ভাল বুঝেন, এমন তো নয়।

সেজন্য ইংরেজির সাথে সাথে বাংলা তরজমাও দিতে হবে। ২। সমস্যা হচ্ছে ইংরেজি লিখে সাথে আবার বাংলা অনুবাদও দেয়া মানে অতি সুক্ষèভাবে পাঠককে অপমান করা, অন্তত আমার তাই ধারণা। ৩। সবচে’ বড় ব্যাপার হলো ভাঙ্গাচোড়া ইংরেজি বলতে বানান না জানলেও চলে।

কিন্তু লিখতে গেলে তো নির্ভুল বানান জানতে হবে। বারবার ডিকশনারীর পাতা উল্টাতে হবে, কী দরকার! পাঠককে তথ্যের সাপ্লাই দেয়ার জন্য এই বই নয়। আমি আমার নিজের গল্পই বলতে চেষ্টা করেছি। তবে এর ফাঁকে পাঠক যদি কোনো তথ্য পেয়ে যান, সেটা তাদের ব্যাপার। পুরো বই জুড়ে হয়তো দেখা যাবে নিজের ঢুলই পেঠাচ্ছি বেশি।

কারণ আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন ‘নিজের ঢুল নিজেই পিঠাইও। অন্যকে পিঠাইতে দিলে ফাটাইয়া ফেলিতে পারে’। ...চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।