গল্পে গল্পে মুক্তিযুদ্ধ
আজ ২৯ মার্চ। বাসা থেকে বের হলাম বিকেল ৫টায়। গেলাম ইষ্ট লন্ডন জুবিলি ষ্টেট এর সবুজ সাথী অফিসে। ২০/২৫ জন বাঙালি কমিউনিটি নেতা এসে জড়ো হলেন। তাদের পূর্ব নির্ধারিত মিটিং।
আমি চলে গেলাম তাদের ষ্টাডি রুমে। ইন্টারনেটে মনোনিবেশ করলাম বাংলাদেশি পত্রিকায়। যথারীতি ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। গ্যাস নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। সিলেটের নিহত কলেজ শিক্ষক হত্যার রহস্য উদঘাটিত।
দেখাগেল প্রেমঘটিত ব্যাপার! গুলশানের জোড়া খুনের আসামী রুবেল ও মিথুন আটক। আশাবাদি হবার মতো কোনো খবরই নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতড়ে বেড়ালাম দেশের আনাচে কানাচে। যদি ভাল কোনো খবর মিলে। খড়ের গাধায় সুই খোঁজার মতো।
মাগরিবের নামাজের পর জমে উঠলো আড্ডা। আড্ডায় জড়ো হলেন বালাগঞ্জ কাজিপুরের আব্দুস সুবহান, বাংলাপোষ্ট পত্রিকার চেয়ারম্যান শেখ মুফিজুর রহমান ফারুক, মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল, এখলাছুর রহমান, কিনুমুল ইসলাম, মছনু ভাই, তাজুল ভাইসহ আরো অনেক।
কথায় কথায় চলে এলো মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। উপস্থিতদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি, তারা ছিলেন পাক হানাদার ও রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতিত।
প্রথমেই স্মৃতিচারণমূলক গল্প শুরু করলেন আজিজুল কামাল। ৭১ এ মাত্র ৫/৭ মিনিটের ব্যবধানে কী করে বেঁচে গিয়েছিলেন, সেই লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা করলেন। নিজ এলাকা বালাগঞ্জে তিনি ছিলেন হানাদার ও রাজাকারদের জন্য এক আতংক। রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা হণ্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাকে। কয়েকদিন তিনি লুকিয়ে ছিলেন এখলাছুর রহমানের বাড়িতে।
সেই এখলাছুর রহমানও সামনে উপস্থিত। কামাল ভাইকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন।
কামাল ভাই ছিলেন আত্মগোপন করে। রাজাকাররা তার অবস্থানের সংবাদ মিলেটারিকে পৌঁছে দিয়েছিলো। রাতে অতর্কিতভাবে এসে বাড়িটি ঘিরে ফেলে তারা।
অবশ্য মিলিটারি আসার ৫/৭ মিনিট আগে কামাল ভাই বুঝে ফেলেন তার অবস্থানের খবর পৌঁছে গেছে। কেউ একজন এসে তাকে জানিয়ে দেয়। তিনি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যান এ বাড়ি থেকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
দীর্ঘ ২ ঘন্টার এই আড্ডায় বেরিয়ে এলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক খন্ড ঘটনা।
খোলামেলা আলোচনাই হচ্ছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পক্ষে বিপক্ষে অবস্থানকারীদের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কামাল ভাই বললেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি মনে করি একাত্তরে যারা পাকিস্তানের সমর্থক ছিলো, তারা অপরাধী নয়। সেটা তাদের অধিকার ছিলো। কিন্তু যারা রাজাকার ছিলো, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, জুলুম-নির্যাতন ও লুটপাট করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, নারী ধর্ষণ করেছে, তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
ঢালাওভাবে আলেম-উলামাকে স্বাধীনতা বিরোধী ভাবা হয়, এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হলে তিনি বলেন, এটা ঠিক যে, দেশের উল্লেখযোগ্য অনেক আলেমই তখন পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন।
তবে সকল আলেমই পাকিস্তানপন্থী ছিলেন, এটা ঠিক না। তিনি বরুনার মরহুম মাওঃ লুৎফুর রহমান সাহেবের নাম উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতার সাথে বলেন, বরুণার পীর সাহেব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে দেশের স্বাধীনতার জন্য দোয়া করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছেন।
একাত্তরের উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনার কথা বলতে বলা হলে কামাল ভাই বললেন, আমার এলাকায় একলোক ছিলো চিিহ্নত রাজাকার।
সে একদিন রাইফেল নিয়ে এসে অতর্কিত হামলা চালালো আমার সাথী এক মুক্তিযোদ্ধার উপরে। কিন্তু অই মুক্তিযোদ্ধা তার হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে রাইফেলের গোড়া দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিলো তার। গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো। লোকটি এই যায় এই যায় অবস্থা। মামলা চলে গেল থানায়।
তখন বালাগঞ্জ ইউপি’র চেয়ারম্যান মরহুম আফতাব উদ্দিন আহমদ। শান্তি কমিটির নেতা মৌলভী ফজলুর রহমান। তবে তারা কেউই কিন্তু যুদ্ধাপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। একাত্তরের পরে মৌলভী ফজলুর রহমান কয়েক মাস জেলে থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো জুলুম নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
জনাব আফতাব উদ্দিন সাহেবের আত্মীয় ছিলেন আইনমন্ত্রী।
উনার সাথে যোগাযোগ করে মৌলভী ফজলুর রহমান সাহেব ও আফতাব উদ্দিন আহমদের উদ্যোগে বিষয়টি অল্পতে মীমাংসা করে দেয়া হয়। বাঁচিয়ে দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাকে।
কত অদম্য সাহসিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি পশুদের মোকাবেলা করেছে, তার স্মৃতিচারণ করে কামাল ভাই বললেন-
খুলনায় ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে ছিল এক বাড়িতে। মিলেটারী খবর পেয়ে বাড়িটি ঘিরে ফেললো। মুক্তিযোদ্ধারা সেটা আচ করতে পেরে তারা তাদের গ্রেনেড পুকুর পাড়ে লুকিয়ে রেখে তারা চারজন পুকুরে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে গেল।
বাড়িতে তখন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। একমাত্র মহিলা আছেন একজন। পূর্ণ গর্ভবতি। যে কোনো মুহুর্তে তিনি মা হবেন-এমন অবস্থা। মিলেটারী এসে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো-
ইহা কয়ি মুক্তি হায়?
মহিলা বললেন, নেহি।
মিলেটারী বললো, তুম ঝুট বুলতা হায়।
মহিলা বললেন, নেহি। কয়ি নেহি।
লুকিয়ে থাকা অই চার মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পরে বলেছিলেন, আমরা পুকুরে ডুবে থেকে কচুরিপানার ভেতর দিয়ে লক্ষ্য করলাম অই মহিলা যখন পাকিস্তানের আর্মিদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন ব্যথায় চোখ মুখ কুকড়ে যাচ্ছিলো তার। অথচ তখন একবারও পুকুরের দিকে তাকান নি।
উনার ভয় ছিলো পুকুরের দিকে তাকালে ওরা যদি বুঝে ফেলে পুকুরে কোনো ঘটনা আছে! সম্পূর্ণ অপরিচিতা অই মহিলার দেশপ্রেম দেখে আমাদের চোখে পানি এসে গেলো।
মিলিটারি বললো, ইয়ে আওরত ঝুট বোলতা হায়। তারপর মহিলাকে বললো, সাচ্ সাচ্ বাতাও। অরনা তুমকো মার ঢালেঙ্গে।
মহিলা বললেন, আমাকে মেরে ফেলতে পারো।
তবুও আমি বলবো এখানে কেউ আসেনি।
এরপর অই পশুরা মেতে উঠলো তাদের স্বভাবসূলভ পৈশাচিকতায়। এক টানে মহিলার শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেললো। তারপর বেয়নেট দ্বারা টান দিয়ে পেট কেটে ফেললো তার। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন মহিলা।
একজন বাঙালি মায়ের এই অবস্থায় তার কোনো সন্তান আর স্থির থাকতে পারে না। লুকিয়ে থাকা অই বঙ্গসন্তানরাও পারেনি। পুকুর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো তারা। মিলেটারি ছিলো ৮জন। তাদের দিকে ছুড়ে মারলো গ্রেনেড।
অন দ্য স্পট আটটি পাকিস্তানি কুকুরের মৃত্যু হলো। তাদের বেকআপে থাকা মিলেটারিদের গুলিতে শহীদ হলেন দুজন মুক্তিযোদ্ধা।
আজিজুল কামাল যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমাঞ্চ করছিলেন, তখন চোখ দু’টি তার ছলছল করছিলো। আমাদের চোখও ভিজে উঠছিলো। তিনি বলেন,
যুদ্ধকালীন সময়ে আমি ভারতে ও পূর্ব পাকিস্তানে, দু জায়গাতেই ছিলাম।
আমি মাঠ পর্যায়ে থেকে দেখেছি ভারত আমাদেরকে সাহায্য করেছে সত্য। তাদের সেনারা আমাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। এটাও সত্য। তবে মূল যুদ্ধটা কিন্তু করেছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা। অরা ছিল কমপ্লিট ট্রেইনআপ।
আর তাদের সাথে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছে আমার দেশের কৃষক শ্রমিক দামাল ছেলেরা। তিনি বঙ্গবীর ওসমানী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, কর্ণেল খালেদ মোশাররফ, মেজর মঞ্জুর, মেজর জিয়া, মেজর জলিল ও মেজর শফিউল্লাহদের নাম উল্লেখ করে বলেন, এই মানুষগুলো তখন যে অদম্য সাহসিকতায় যুদ্ধ করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, সেটা নিজ চোখে দেখেছি আমি।
কথায় কথায় কখন যে রাত ১০টা বেজে গেছে ঠেরই পাইনি। রাতের খাবারের দাওয়াত ছিলো আশিক ভাই’র বাসায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাসায় ফিরলাম আমরা।
এরই মধ্যে তাজুল ভাইকে ফোন করলেন বাংলা পোষ্ট পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জনাব কে এম আবু তাহের চৌধুরী। সাহিত্য আসরের কী করা হলো, জিজ্ঞেস করলেন।
তাজুল ভাই তাকে জানালেন, বাংলাদেশ থেকে দু’একদিনের মধ্যেই রশীদ জামীলের বই’র পার্শেল এসে পৌঁছে যাবার কথা। বইগুলো এসে গেলেই তারিখ ঠিক করা হবে।
ফোন করলেন সালেহ হামিদী।
হামিদী ভাইয়ের দায়িত্ব ছিলো এটিএন বাংলা ও ইকরা টিভির সাথে কথা ফাইনাল করে টিভি প্রোগ্রাম সেট করা। তিনি জানালেন, প্রোগ্রাম ইকরা টিভিতে করলেই ভাল হবে। ইকরা টিভির মালিক ইমাম কাসিমের সাথে কথা হয়েছে আমার। দু একদিনের মধ্যেই তারিখ ঠিক হয়ে যাবে।
হামিদী ভাই’র সাথে লন্ডনের সবগুলো বাংলা টিভি চ্যানেলের সম্পর্ক ভাল।
তিনি নিজেও একজন জনপ্রিয় প্রেজেন্টার। বাঙালি কমিউনিটিতে তার একটা এক্সট্রা অডিনারী জনপ্রিয়তা রয়েছে।
বাসায় ফিরে জমে উঠলো ঘরোয়া আড্ডা। আমি, ইউসুফ ও ওয়েস। অঘোষিত সভাপতি তাজুল ভাই।
আলোচনা চলতে লাগলো জমিনের নিচ অথবা আকাশের উপরের প্রসঙ্গে। দেখা গেলো, তাজুল ভাই সৌরজগত সম্বন্ধে যথেষ্ট মেহারত হাসিল করে বসে আছেন। বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের নাড়িভুড়ির খবর তার নখ দর্পনে। চললো ভোর রাত পর্যন্ত-
...চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।