আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (২০)


বন্ধুতা ইপসউইচ যাবার কথাছিলো আগামী কাল। ৬ বছর এক প্লেটে ভাত খাওয়া আমার সবচে’ কাছের বন্ধু, ক্লাসমেট ইউসুফ সালেহ থাকে ওখানে, স্বপরিবারে। আমি গিয়ে পৌঁছার পর খুব আগ্রহ করে ফোন দিয়েছে। কয়েকদিনের জন্য তার ওখানে চলে যাবার তাগাদা দিয়েছে। বলেছি, হাতের কাজ একটু হালকা হলেই চলে আসবো।

বলেছে যেদিন আসবি, তার আগের দিন ফোন দিস। আমি বলেছি, আচ্ছা ঠিক আছে। সেদেশের ছেলে-মেয়ে সারা বছর স্কুলে টাইট শিডিউলে থাকে। যাকে বলে নট নড়ন-চড়ন। বছরে একবারই সামান্য রিলাক্সের সময় পায়।

সেটা সামারে। স্কুল ছুটি দেয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চারা মা বাবাকে নিয়ে এই ক’দিন হৈ-হুল্লোড় করে ঘুরে বেড়ায়। আমি যখন তাজুল ভাইকে বলেছি, আমি দু’দিনের জন্য ইপসউইচ যেতে চাই, সালেহ ভাই’র ওখানে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, কবে যেতে চান? আমি বলেছি ৩ তারিখ।

তিনি বলেছেন, ওকে। আমি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। সন্ধ্যায় ফোন করলাম ইউসুফ সালেহকে। তখন সে শিক্ষকতায় ব্যস্ত। বললো, পরে ফোন দেই? বললাম, ঠিক আছে।

রাত ১০টায় ফোন হলো। বললাম, আগামীকাল তোমার ওখানে আসতে চাইছি। সালেহ ভাই বললো, ইয়ে মানে, দু'’চারদিন আগে বললে ভাল হতো। আমি বললাম, কেন! কোনো সমস্যা? বললো, না ঠিক আছে। বললাম, ঠিক নেই বুঝতে পারছি।

আমি কি আরো দু’'পাঁচদিন পরে আসবো? বললো, সেটা হলে তো খুব ভাল হয়। হয়েছে কি, স্কুল হলিডে শুরু হয়েছে তো। বাচ্চাদের নিয়ে হলিডে ট্যুরে যাবার প্লান করেছিলাম। তুই আগামীকাল আসলে যা, ৫ দিন পরে আসলেও তা। অবশ্য খুব ইমার্জেন্সি হলে ট্যুরের প্রোগ্রাম বাতিল করে দিতাম।

আমি বললাম, না, না, প্রোগ্রাম বাতিল করার তো প্রশ্নই আসে না। তুমি ঠিকই বলেছো। আমি কাল এলে যা, দুদিন পরে এলেও তা। সে বললো, আমি জানতাম সিচুয়েশনটা তুই বুঝতে পারবি, থ্যাংক য়্যূ। ফোন রেখে দিলাম।

দু’ পাঁচদিন পরে সালেহ ভাই’র ওখানে আর যেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। সামনে টাইট শিডিউল। সঙ্গে ঘরে ফেরার তাড়া। তাছাড়া... থাক সে কথা। সালেহ ভাই’র কথায় আমি মোটেও মন খারাপ করলাম না।

অন্যকেউ হলে কী করতো, জানিনা। তবে আমি জানি, এদেশের মানুষের জীবনটা চলে আন্ডার ডিসিপ্লেন। মানুষগুলোও ডিসিপ্লেন্ড হতে হতে কেমন জানি যান্ত্রিক হয়ে গেছে। যাকে বলো পুরো দস্তুর যন্ত্রমানব। ইচ্ছে করলেই তারা যখন তখন এবং যে কাউকে সময় দিতে পারে না।

অবশ্য ইচ্ছেটা করার ইচ্ছেই তারা করে কিনা, সেটা একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন। আমার একটা বদ খাসলত আছে। যাদের খুব কিছু নেই, টাকা পয়সা, আভিজাত্য, উচ্চ মর্যাদা, তাদের মধ্যে এই খাসলতটি থাকে। এবং বেশ ভালভাবেই থাকে। সেটা হলো ‘ইগো কাতরতা’।

‘গায়ে না মানলে আপনে মোড়ল’ অথবা ‘মান ইয়া না মান, ময় তেরা মেহমান’ নীতি তাদের পছন্দ না। আমি কখনো কারো বিরক্তির কারণ হতে চাইনি। হতে চাইবোও না কোনোদিন। তাজুল ভাই যুক্তরাজ্য নিয়ে গেছেন। এমন নয় যে, আমার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই ওখানে।

অনেকেই আছেন। এ পর্যন্ত কারো সাথেই যোগাযোগ করি নি। কী দরকার! আত্মীয়রা কেউ তো কখনো আমাকে বলেন নি, আয়, একবার এ দেশটা দেখে যা না। তাজুল ভাই বলেছেন। নিয়ে এসেছেন।

তার বাসায় আছি নিজের বাড়ির মতো। তার ছোট্ট মেয়েরা আপন মামার মতোই মামা ডাকছে। কাছে ভিড়ছে। চাইবার আগেই সবকিছু পাচ্ছি। ইপসউইচ যে যেতেই হবে, এমনও তো কোনো কথা নেই।

অবশ্য একটি ব্যাপার ভাবতেই ভাবনাগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলো। একগুচ্চ অস্বস্থি এসে ঘিরে ধরলো আমাকে। নিজেকে আমার বড়বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো। এতবেশি অসহায় এর আগে কখনো মনে হয় নি। নেভার এভার।

আমি ইপসউইচ যাবার কথা বলার পর তাজুল ভাই বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যাবার প্লান তৈরি করেছেন। এই সময়ে দু’টি বিয়ের প্রোগ্রামেও অ্যাটেন্ড করার পরিকল্পনা করেছেন। আমার ইপসইউচ প্রোগ্রাম স্থগিত করার কারণে এখন তাজুল ভাইকেও তার ফ্যামিলি প্লানে চ্যাঞ্জ আনতে হবে। ব্যাপারটি যথেষ্ট অস্বস্থিতে ফেলে দিলো আমাকে। আমার এই অস্বস্থি তাজুল ভাই’র কারণে নয়, তাঁর ছোট্ট মেয়েগুলোর কারণে।

সারা বছর ধরে তারা এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে। স্কুল ছুটি হবে। তারা ঘুরে বেড়াবে। এখন আমার কারণে তাদের এই হলিডে যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে ছোট্ট এই মেয়েগুলোর অনুভূতিতে বেশ বড় রকমের আঘাত লাগবে। তাদের অবচেতন মন, তাদের কচি বিবেক, তাদের আবেগী মন আমাকে বসিয়ে দেবে ভিলেনের আসনে।

আমি হবো তাদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ। ব্যাপারটি মোটেও ঠিক হবে না। আবার এই নিরব সমস্যার আপাত-দৃষ্টিতে আমি কোনো সমাধানও দেখছি না। এরই মধ্যে নর্থ লন্ডন থেকে ফোন করলেন চাচাতো ভাই মুজিবুর রহমান। ঝাঝালো কন্ঠে বললেন, কিরে! তুই এখনো এলি না? আমি বললাম, দেখি, আগামীকালই চলে আসতে পারি।

বললেন, আসবি কিভাবে? রাস্তাঘাট তো কিছুই চিনিস না। তুই তোর ঠিকানা বল। আমি বললাম, আপনি আপনার পোষ্টকোড বলেন, আমি চলে আসবো। যেখানে আছি সেই বড়ভাই আমাকে পৌঁছে দেবেন। তিনি এড্রেস বললেন।

লিখে রাখলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই ফাঁকে আত্মীয়তাও হয়ে যাবে আর যে মেয়েগুলো দুই সপ্তাহ ধরে আপন মামার মতো আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে আমাকে, মুখ ভরে মামা ডাকছে, বাসায় থাকলে কিছুক্ষণ পরপর চা কফি লাগবে কিনা-জিজ্ঞেস করছে, পান এনে দিচ্ছে, ছোট্ট নাশিতা পানে জর্দা ঢেলে দিচ্ছে, কখনো পান মুখে তুলে দিচ্ছে, আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তাদের মন ভাঙ্গার কারণ আমাকে হতে হবে না। রাতে তাজুল ভাইকে নিয়ে বসে ইন্টারনেটে দেশের পত্রিকা পড়ছি। বললাম, তাজুল ভাই, আপনার টিভি প্রোগ্রামের কী হলো? তিনি বললেন, একটু আগেই ডেট কনফার্ম হলো, ১৪ তারিখ।

বললাম, ১১ তারিখ গ্রন্থ প্রদর্শনী প্রোগ্রাম ঠিক আছে না? তিনি বললেন, হ্যা, আছে তো। আমি বললাম, তাহলে আমাকে এখানে বসে থাকলে চলবে কেন? প্রোগ্রাম এ্যারেঞ্জমেন্টের জন্য আমার কি উচিৎ না হোয়াইট চ্যাপেলের আশেপাশে কোথায় অবস্থান করা। আপনার বাসা থেকে যেতে আসতেই তো ১ ঘন্টা চলে যায়। তিনি বললেন, আপনি কী করতে বলেন? আমি বললাম, সপ্তাহখানেকের জন্য হোয়াইট চ্যাপেল বা তার আশে পাশে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? তিনি বললেন, কোথায় যেতে চান? কার কাছে? আমি বললাম, সেটা আমি কী করে বলবো। সেটা তো ঠিক করবেন আপনি।

তিনি চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবত দেখতে চেষ্টা করলেন আমার কথার অন্য কোনো তরজমা আছে কিনা। আমি স্বাভাবিক এবং বাস্তবিক চেহারায়ই তাকালাম তার দিকে। তিনি আশ্বস্থ হলেন। আমি মন থেকেই বলছি।

প্রোগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে। বললেন, দেখি। আমি খুব করে চাইছি যেনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাজুল ভাই কার কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে জানালেন, ব্যবস্থা পাওয়া গেছে। আমি মনে মনে চাচাতো ভাই এর কাছে ক্ষমা চাইলাম।

বললাম, ভাইজান, জীবনে তো কখনো খোঁজ নাও নি। কখনো তো গায়ে পড়ে আমিও দ্বারস্থ হই নি। স্যরি ভাইজান, আমি আর আসছি না। আমি এখানে আসার আগে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম আত্মীয় স্বজন কারো করুণার ধারে-কাছেও যাবো না। কারো করুণার স্পর্শ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বেই রাখবো।

আলোচনার এই ফাঁকে ফরেস্টগেট থেকে এসে উপস্থিত হলেন আলহাজ্ব আতাউর রহমান এবং সিলেট জৈন্তার মাওঃ নাজিম উদ্দিন। নাজিম উদ্দিন সাহেবের খুব ইচ্ছে লেখক রশীদ জামীলের সাথে দেখা করবেন। প্রায় ঘন্টা খানেক আতাউর ভাইদের সাথে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলো। তিনি তার খিদমাহ একাডেমীতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি বললাম, জ্বি আসবো।

অবশ্যই আসবো। ...চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।