আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (১৫)



ড্রাগ ডিলিংস আজ ২৬ মার্চ ২০১০ইং। সকাল ১১টা। বসে বসে বাংলা টিভির মাধ্যমে সংবাদ পেলাম আজ পূর্ব লন্ডনে একটি পানির পাম্প বাস্ট মেরেছে। ফলে ৪ হাজার বাসা-বাড়িতে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। অবশ্য কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সমস্যাটির সমাধান হয়ে যাবে, এমনটিই জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

আজ শুক্রবার। জুমার নামাজ আদায় করলাম পেকহাম ইসলামিক সেন্টারে। নামাজের আগে আফ্রিকান পেশ ইমাম ২০ মিনিট ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলেন। তারপর মূল পাকিস্তানি ইমাম বক্তৃতা দিলেন উর্দুতে। নামাজ শেষে বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া করে ২ ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম।

লন্ডনে দিনের বেলা ঘুমাতে কেমন লাগে, এই অভিজ্ঞতাওতো থাকা দরকার। রাত ৯টায় আমি ও ইউসুফ চলে গেলাম ইস্ট লন্ডনে। পৌনে দশটায় ইস্ট লন্ডন মসজিদে এশার নামাজ আদায় করলাম। লন্ডনের সবচে’ বড় মসজিদ হলো এই ইস্ট লন্ডন মসজিদ। মসজিদের উল্টো পাশেই সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকার অফিস।

দৈনিক ব্রিট বাংলার অফিসও এখানে। পাশেই বাংলাদেশি পণ্যের দোকান। দোকানের নাম ‘মাছ বাজার’। বাংলায় মাছ বাজার সাইনবোর্ড লাগানো। চলেগেলাম আলতাব আলী পার্কে।

গত রাতে ফুলের স্তুপ ছিল। আজ আর নেই। হেলথ ডিপার্টমেন্ট এবং সিটি কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার করে ফেলেছে। পার্কের কোণায় কিছু ছেলে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট টানছে আর তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক।

আচরণ সন্দেহজনক। ইউসুফকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এরা ড্রাগস ড্রিলিংস’র সাথে জড়িত থাকতে পারে। এদের অনেকেই স্টুডেন্ট ভিসায় আমদানি। কাজ-কাম না পেয়ে পেটের দায়ে বেছে নিয়েছে এই অন্ধকার পথ। রাত ১০টায় ফিরে এলাম বাসায়।

বাসায় ফিরতেই এসে ঝেকে ধরলো সায়মা ও নাশিতা। আমি যখন ডায়রীতে আজকের টুকিটাকি লিখছি, তখন তারা এসে বললো, মামা, আমরা আজ আবার ইন্টারভ্যূ দিতে চাই। বললাম, দিয়েছো তো একদিন। আবার দিতে চাই। ঠিক আছে, বলো কী বলবে? সায়মা বললো, প্রশ্ন করেন।

বললাম, ধরো তোমাকে যদি প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাহলে তুমি কোন্ দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চাইবে? বাংলাদেশের না ইংল্যান্ডের। সায়মা বললো, আমেরিকার। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমেরিকার কেন? সে বললো, আমেরিকা একটি ষ্ট্রং কান্ট্রি। সেদেশের প্রেসিডেন্টের পাওয়ার আছে। অনেক বেশি পাওয়ার।

আমি বললাম, পাওয়ার দিয়ে তুমি কী করবে? সে বললো, ইসরাইলকে মারবো। ওরা ফিলিস্তিনের ছোট বাচ্চাদের হত্যা করে। আমি তাকালাম সায়মার দিকে। ছোট্ট মেয়ে। বয়স মাত্র ৮।

অথচ আন্তর্জাতিক বিশ্বেরও খবর রাখছে। আমাদের দেশে কি এটা কল্পনা করা যায়? জিজ্ঞেস করলাম, সারা বিশ্বে তোমার পছন্দের ও অপছন্দের দেশ কোন্টি? বললো, পছন্দের দেশ বাংলাদেশ। কারণ ঠান্ডা কম। মায়ের দেশ, বাবার দেশ। আর সে ঘৃণা করি পাকিস্তান।

বিস্মিত হলাম আমি। সে নিশ্চয়ই আমার মতো একাত্তরের ভূমিকার কারণে পাকিস্তানকে অপছন্দ করছে না। অন্য কারণ আছে। কারণটা কী? জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তানকে কেন ঘৃণা করো তুমি? সে বললো, ওরা প্রচন্ড মিথ্যে কথা বলে। সায়মার সাথে স্কুলে এবং মক্তবে অনেক পাকিস্তানি ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করে।

সে সম্ভবত তাদের উপর জরিপ চালিয়েই এই তথ্যটি আবিষ্কার করছে। আমি সায়মার সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বহুদিন পর আমি এমন কাউকে পেয়েছি, যে আমার মতো পাকিস্তানকে ঘৃণা করে। তাজুল ভাই পাশে বসে আমাদের এই কথাবার্তা শুনছিলেন আর হাসছিলেন।

এবারে তিনিও অংশগ্রহণ করলেন। বললেন, কথাটা একেবারে মন্দ বলেনি মেয়ে। পাকিস্তানিরা আসলেই মিথ্যে বলে বেশি। কিছু কিছু দোকানী আছে যারা ‘খোদা কি কসম’ বলেও মিথ্যে বলে! তিনি বললেন, কিছুদিন আগে এক পাকিস্তানি ছেলে তার মাকে নিয়ে দেশে যাচ্ছিলো। ছেলে ছিলো ড্রাগ ড্রিলিংস’র সাথে জড়িত।

তার সাথে ছিল হিরোইন। হিথ্রোতে যখন কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না বলে নিশ্চিত হয়ে গেল এবং ভাবলো, ধরা পড়লে অবধারিতভাবেই সাত বছরের জন্য জেলে যেতে হবে, তখন সে হিরোইনের পুটলাটি তার মায়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো। চেকিংয়ে যথারীতি মা ধরা খেলেন। মা তাকালেন তার ছেলের দিকে। যে ছেলেকে ১০ মাস পেটে ধরেছেন, অনেক ঠান্ডার রাত না ঘুমিয়ে ছেলেকে যত্ন করেছেন, সেই ছেলের দিকে।

ছেলের দিব্যি অস্বীকার করে বসলো। তার সাফ কথা, এই মাদকদ্রব্যের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ মাকে ধরে নিয়ে গেল ৭ বছরের জন্য। আর গুণধর পুত্র চলে গেল নিজ দেশে। পাকিস্তানি জাতি কত যে অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম, সেটা বুঝবার জন্য আরও কী চাই।

নাশিতা এতক্ষণ ধরে আমার কোলে বসে সাক্ষাৎকার দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর অপেক্ষা করছিলো। তাকে বললাম, নাশু, তোমার কথা কাল লিখবো, কেমন? সে বললো, আমি এতক্ষণ ওয়েট করলাম... আমি বললাম, প্লি...জ! সে মুখ গুমরা করে বললো, ও-কে। রাতে বেডে গেছি। প্রথম দিকেই জানিয়েছিলাম খাটটি ছিলো দু’তলা। আমি শুয়েছি নিচে, ইউসুফ উপরে।

ঘুম আসছিলো না। কথা জুড়ে দিলাম ইউসুফের সাথে। ড্রাগ ড্রিলিংস নিয়ে। আমি তাকে বললাম, আচ্ছা ইউসুফ, তুমি তো তোমার কৈশোরের দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছো এখানে। এখনো দেখছো।

তুমি বলতে পারবে। একটা জিনিষ আমার মাথায় ঢুকছে না। এদেশে মদ বৈধ। যত্রতত্র মদ পাওয়া যায়। যে কেউ যেখানে ইচ্ছা মদ খেয়ে মাতলামী করতে পারছে।

তাহলে ড্রাগ ড্রিলিংস মানে কি? ড্রাগ মানে কি নেশাদ্রব্য নয়? তবে কেন এর বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশন? ইউসুফ আমাকে যে জবাব দিলো, সেটা আমার কাছে যৌক্তিকই মনে হলো। ঘটনা হচ্ছে, এখানে দুটি বিষয় কাজ করে। এক হলো, সরকার মুখে বলে কেউ ড্রিংক করতে চাইলে ক্লাব আছে, বার আছে, রেষ্টুরেন্ট আছে। সেখানে গিয়েই করবে। বাইরে আনাচে কানাচে মদ খেয়ে মাতলামী করবে অথবা মদ্যপ নয়, এমন লোকেদের ডিস্টার্ব করবে, এটা ঠিক না।

তাছাড়া মাঠে ঘাটে যেসব মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, সেটার গুণগত মান খুব খারাপ। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটা হলো সরকারের বাইরের বক্তব্য। আর ভেতরের কথা হলো, ক্লাবে বা রেষ্টুরেন্টে যারা মদ খাচ্ছে, তারা এ জন্য সরকারকে ট্যাক্স পে করছে। বাইরে থেকে লাইসেন্সবিহীন লোক বা জায়গা থেকে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করলে সেখান থেকে তো ট্যাক্স পাওয়া যায় না।

আমার কাছে ইউসুফের বক্তব্য পছন্দ হলো। আসলেই গুণগত মান ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকির ব্যাপারটি জাস্ট আইওয়াশ মাত্র। পৃথিবীর কোনো ডাক্তারকে আমি বলতে শুনিনি মদ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বরং সকল ডাক্তারই ফতোয়া দিয়েছেন, মদ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মদ লান্স নষ্ট করছে, লিভার ডেমেজ করে দিচ্ছে, ফুসফুসে ক্যান্সারের জীবাণু পর্যন্ত সাপ্লাই দিচ্ছে। একজন সুস্থ-সবল মানুষের সুন্দর ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে মাদক।

সুতরাং নিম্নমানের নেশা করলে মানুষের তবিয়ত খারাপ করবে, এই চিন্তায় ব্রিটিশ সরকারকে অস্থির ভাবার কোনো কারণ নেই। আসল কথা হলো ট্যাক্স। মানুষ বাঁচুক আর মরুক, তাদের দারকার ট্যাক্স। মউতা জান্নাত মে যায়ে ইয়া জাহান্নাম্মে, উনকো হালুয়া কি জরুরত হে। ব্রিটিশ সরকার মোটামুটি সবকিছুতেই ট্যাক্স বসানোর কাজ শেষ করে ফেলেছে শুধু মৃত্যু ছাড়া।

হয়ত একদিন মানুষ মরলে মরার উপরও ট্যাক্স ধার্য করে ফেলতে পারে। আল্লাহ তাদের তৌফিক দিন। আমিন। ইউসুফের সাথে কথা বলছি। তখন ফরেষ্টগেট থেকে ফোন করলেন আতাউর ভাই।

খিদমায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিলেন। কথাহলো সোমবারে যাওয়া হবে। একটু পরে ফোন করলো ছোটভাই আনওয়ার। আমার ব্যবসায়িক পার্টনার কাম বড়ভাই মাওঃ মাসুদ আহমদ মাশুকের ছোটভাই। সে থাকে নর্থহ্যাম্পটন।

সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করলো, ভাই, আমার এখানে কবে আসছেন? আমি বললাম, দেখি। তোমাকে ফোন দিয়েই আসবো। তুমি এসএমএস করে তোমার পূর্ণ ঠিকানা আমাকে পাঠিয়ে দিও। পাঠককে একটি মজার তথ্য জানিয়ে দেই। আজ শুক্রবার।

আজ গুড ফ্রাইডে। খ্রিস্টান জাতির কাছে বরকতি শুক্রবার। সারা বছর শুক্রবার থাকে ৫২টি। তার মধ্যে এই একটি শুক্রবারই তাদের কাছে কদর পায়। মদের ডোজ অই দিন একটু বাড়িয়ে দেয় আর কি!! ...চলবে


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।