হিথ্রো বিমানবন্দর
লন্ডন স্থানীয় সময় বিকেল ৫ টা ৪৫ মিনিটে ধীরে ধীরে বিমান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আমাদের অবস্থান টার্মিনাল নং ৪এ। চলন্ত লিফট আছে তবে চড়তে ইচ্ছে করছে না। দুইবারে ১৩ ঘন্টা বিমান জার্নি, মধ্যেখানে আবুধাবিতে ৫ ঘন্টা বসে বসে ‘অপেক্ষা’ শব্দটি বানান করা, সব মিলিয়ে হাটতেই ভাল লাগছে। হাটতে হাটতেই এসে দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশনের লাইনে।
আমার সামনে লাইনে আছে কয়েক’শ মানুষ। পেছনে কত আছে হিসেব নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বিভিন্ন মকসুদে যুক্তরাজ্য এসে থাকে। কৌতূহলী চোখে চতুর্দিকে তাকাচ্ছি আমি। বিশাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
২১টি বুথ নিয়ে ২১ জন কর্মকর্তা একই সাথে কাজ করে চলেছেন। সঙ্গত কারণেই মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার সামনের মানুষগুলো হাওয়া হয়ে গেলো। এবার আমার পালা।
মাস কয়েক আগে দুবাই এয়ারপোর্টের হয়রানীর কথা মনে করে কিছুটা ভয় করছিলো আমার। দুবাই মুসলিম কান্ট্রি।
তারপরও যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়েছিল ইমিগ্রেশনে। আর এটা তো অমুসলিম দেশের ইমিগ্রেশন। না জানি কী না কী হেরাসমেন্ট করে?
আমার সিরিয়াল পড়লো ১৯ নাম্বার কাউন্টারে। সেখানে কাজ করছেন এক মহিলা। দেখে মনে হলো ফিলিপাইনের মহিলা হবেন তিনি।
বয়স ৩০ থেকে ৩৫ এর ভেতরেই হবার কথা। ধুরু ধুরু বুকে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। যদিও ভয় পাবার কোনো কারণই ছিল না। বৈধ কাগজপত্রে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই যাচ্ছি আমি। তবুও।
দুবাইও তো বৈধভাবেই গিয়েছিলাম কিন্তু অই ব্যাটারাও তো জ্বালাতন কম করেনি।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভদ্র মহিলা এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন,
হ্যালো স্যার! হাউ আর য়্যূ?
চমৎকৃত হলাম আমি। সকল ডর-ভয় উড়ে গেল। এই মহিলা নিশ্চই আমার শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবার জন্য ‘হাউ আর য়্যূ’ বলেন নি। তিনি তার পেশাগত দায়িত্বই পালন করেছেন।
তবে তার এই সৌজন্যমূলক বাক্য আমার মনোবলের ঘাড়তি দূর করে দিল। যে মহিলা এত সুন্দর করে কেমন আছি জানতে চাইতে পারে, সে অন্তত অসুন্দর কোনো আচরণ করবে না। এই ভরসা রাখাই যায়।
আমি বললাম, ফাইন।
সে বললো, পাসপোর্ট দিন।
আমি পাসপোর্ট, আরোহন কার্ড ইত্যাদি বুঝিয়ে দিলাম। মিনিট মতন সময় নিয়ে আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন। কম্পিউটারে মিলিয়ে দেখলেন। এবং ফাঁকে ফাঁকে কথাও চালিয়ে গেলেন। একগাধা প্রশ্ন করলেন কিন্তু একবারও আমার মনে হলো না আমাকে বিব্রত করা বা বেকায়দায় ফেলবার জন্য কোনো প্রশ্ন করছেন।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাকে যে প্রশ্নগুলো করলেন, তা হলো-
আপনি মিস্টার রশীদ জামীল?
জ্বি।
আপনার বার্থডে টা যেন কবে?
১লা জুলাই ১৯৮০ইং
এই প্রথম আসলেন?
জ্বি
দুবাই কবে গিয়েছিলেন?
২০০৯ এ।
আপনার পাসপোর্ট অনুযায়ী আপনার পেশা ব্যবসা। দুবাই ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন?
না ম্যাডাম, আমার আরেকটি ছোট্ট পরিচয় আছে, আমি একজন লেখক।
ও আচ্ছা, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
পাসপোর্টে তো দেখছি ইতালির ভিসা লাগানো হয়েছিলো। যাননি কেন?
ম্যাডাম, তখন হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
ও। আচ্ছা আপনাকে তো ইউকের ভিসা দেখা হয়েছিলো ২৯ অক্টোবর ০৯ থেকে। আর আপনি ইন করছেন ৫ মাস পরে।
এত দেরিতে কেন? মেয়াদ তো মাত্র এক মাস আছে।
আমি বললাম, দেখুন ম্যাডাম, আমি এক মাসের ভিসার জন্যই এ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমার জন্য এক মাসই যথেষ্ট সময়। আপনার ব্রিটিশ এম্বেসি ৬ মাসের ভিসা দিয়েছে। আমার দরকার ছিল না।
আমার দিকে এবার ভাল করে তাকালেন তিনি। হাসি হাসি কন্ঠে বললেন, আমার ৭ বছরের চাকরী জীবনে আপনিই প্রথম, যিনি ভিসা পাওয়ার ৫ মাস পরে এলেন। অন্যরা তো এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসে।
আমি আর কিছু বললাম না। আমার পাসপোর্ট সিল দিয়ে ভদ্রমহিলা ফেরৎ দিলেন।
বললেন, ওলেকাম টু ইউকে। হেভ এ নাইস ট্রিপ।
আমি বললাম, থ্যাংক য়্যূ মেম।
ইমিগ্রেশন ক্রস করে পা বাড়ালাম সামনের দিকে। ইন্সট্রাকশন ফলো করে করে বেল্ট খুঁজে বের করলাম।
লাগেজ নিয়ে একটু সামনে এগুতেই এক ইংলিশ কর্মকর্তা লাগেজ চেক করতে চাইলেন। আমি খুলে দিলাম। পান সুপারী ছাড়া অবৈধ আর কিছু তো নেই। দেখুক না ভাল করে। শুধু সমস্যা হবে পান-সুপারীগুলো যদি ফেলে দেয়।
আমার লাগেজের তিন চতুর্থাংশ জুড়েই ছিল বই। তিনি বললেন, এত বই কেন?
বললাম, এগুলো আমার লেখা। বন্ধু-বান্ধবকে গিফট করবার জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
তিনি লাগেজের প্রতিটি কর্ণার চেক করতে লাগলেন। আমি চিন্তিত পানের জন্য।
তখন মনে পড়লো বিশ্বনবী যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যান, সে রাতে মক্কার কুরাইশরা নবীজির ঘরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিলো। তাদের হাতে উন্মুক্ত তরবারী। তারা নবীকে হত্যা করতে চায়। নবীজি তখন একমুষ্টি ধুলো মুঠোয় নিয়ে সুরায়ে ইয়াসিনের প্রথম দিকের কয়েকখানা আয়াত তেলাওয়াত করে ফু দিয়ে সেই ধুলো ছিটিয়ে দিলেন চতুর্দিকে। কাফেরদের চোখের সামনে।
ফলে তারা সবকিছুই দেখছিলো কেবল নবীকে ছাড়া। নবীজি তাদের চোখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন।
ইংলিশ অই কর্মকর্তা যখন আমার লাগেজ চেক করছিলো, তখন আমিও মনে মনে পাঠ করতে লাগলাম সুরায়ে ইয়াসিনের সেই আয়াতগুলো, ফা-আগশাইনাহুম ফাহুম লা ইউবসিরুন.........।
কর্মকর্তা তিন কোণ দেখলেন। কিন্তু যে কোণে পান সুপারী ছিল, সেটা আর দেখেই বললেন, ইউ মে গো নাউ।
মনে মনে বললাম থ্যাংক য়্যূ আল্লাহ। আমার পান সুপারীর গাট্টিটি বাঁচিয়ে দেবার জন্য তোমাকে অনেক অনেক এবং অনেক ধন্যবাদ।
...চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।