আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (৪)



ইত্তেহাদ এয়ারওয়াইজ ঢাকা টু আবুদাবি ইত্তেহাদ হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় বিমান। বর্তমান বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ইত্তেহাদ এয়ারওয়াইজ। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ইত্তেহাদের সার্ভিস শুরু হয় ২রা জুলাই ২০০৩ সালে। উদ্বোধন করেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। বিশাল বিমান।

অত্যাধুনিক সকল সুযোগ সুবিধাই রয়েছে। প্রতিটি সিটের সাথে ইন্ডিভিজুয়েল মনিটার তো আছেই। ঢাকার মশাও আছে। ওদের তো আর পাসপোর্ট-ভিসার ব্যাপার নেই। টিকেটও করতে হয়নি।

পায়ে জ্বালা তুলে ফেললো কামড়ে। আমাদের মশাদের এই উন্নতি দেখে অবশ্য খারাপ লাগলো না। ফ্লাইট নম্বার EY 253। ভোর ৫টায় পাইলট মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিলেন কিছুক্ষণের মধ্যে বিমানটি যাত্রা শুরু করছে। সবাই যেন সিটবেল্ট বেধে ফেলেন।

উনার উদ্বোধনী বক্তৃতার মাধ্যমে জানা গেল বিমানটি চালনার মূল দায়িত্বে আছেন, তার নাম শন। নাম শুনে বুঝার উপায় নেই মেড ইন কোন্ দেশ! মনিটরে ভেসে উঠলো ভ্রমণের দোয়া, উচ্চারণসহ। সুবহানাল্লাজি সাখ্খারালানা হা-জা ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন। এরই মধ্যে একজন কো পাইলট তসবীহ টেপার মেশিনের মত একটি মেশিন টিপে টিপে যাত্রী গণনা করে গেলেন। ঠিক ৫টা ১০ মিনিটে ইত্তেহাদ এয়ারওয়াইজের ফ্লাইটটি যাত্রা করলো আবুদাবির উদ্দেশ্যে।

৩৮ হাজার ফিট উপর দিয়ে ভেসে চললো আমাদের গাড়ি। ৮৯০ কি: মি: প্রতি ঘন্টা গতিতে। মনিটরে ক্লিক করে জানলাম আউটসাইড এয়ার টেম্পারেচার মায়নাস ৪৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঠান্ডার পরিমাণ কত হতে পারে, যাদের ধারণা নেই, তাদের জন্য বলি, ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যখন প্রচন্ড ঠান্ডা থাকে, বরফ বৃষ্টি হয়, তখন সেখানকার তাপমাত্রা থাকে মায়নাস ৬/৭ ডিগ্রী। আবুদাবির সাথে আমাদের সময়ের ব্যবধান তিন ঘন্টা।

৫ ঘন্টা জার্নি করে আবুদাবি লোকাল টাইম সকাল ৮টা ১০ মিনিটে আমরা অবতরণ করলাম আবুদাবি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের টার্মিনাল নং তিন’-এ। আলো-আঁধারির খেলা শেষ হয়ে ভোরের আলো ঠিকমত ফুটে উঠার আগেই আমরা আবুদাবি পৌছে গেলাম। ইলেকট্রনিক ইন্সট্রাকশন ফলো করে করে এগিয়ে চললাম সামনে। আবুদাবি টু লন্ডন ফ্লাইট দুপুর ১টা ৩০ মিনিট। টানা ৫ ঘন্টা ট্রানজিট।

বিরক্তিকর অলস অপেক্ষা ছাড়া উপায় কী? এখন সময় কাটানোর উপায় দুটি। এক/ এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে মসজিদে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। দুই/ ঘুরে দেখা। আমি দ্বিতীয়টিই বেছে নিলাম। ঘুমিয়ে থাকলে ঝুঁকি আছে।

খুঁজে বের করে যে ডেকে নিয়ে যাবে, কী গ্যারান্টি আছে? এয়ারপোর্টের ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমি। কিছু দূর অগ্রসর হয়ে লক্ষ্য করলাম বিশাল একটি উট বসে আছে। রঙিন কাপড় পরে। ভাবলাম এয়ারপোর্টের ভেতরে উট আসলো কোত্থেকে? আস্তে আস্তে কাছে গেলাম। অবিকল জীবন্ত উটের মতো দেখালেও এটা সত্যিকারের উট না।

উটের মূর্তি। তবে দূর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। আরো একটু সামনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম গ্লাসবদ্ধ চৌকোনো একটি ঘর ধোঁয়ায় ভরে আছে! প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম। আগুন টাগুন লেগে গেলে তো সমস্যা। অবশ্য একটু পর পরই Fire exit লেখা গেট আছে।

কিন্তু তাড়াহুড়ার মধ্যে বের হতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েই তো মারা যেতে হতে পারে। একটু পরেই আমার ভয় উড়ে গেলো। জানাগেল এটা স্মোকিং জোন। ওখানে আগুন লাগেনি। স্মোকার ভাইরা তাদের সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন জাহাজের মতো! কিছু দূর অগ্রসর হয়ে আবিষ্কার করলাম কাষ্টমার সার্ভিস।

বেশ খোশ মেজাজে ওখানে বসে আছেন ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা এক কর্মকর্তা। কাছে গেলাম আমি। সালাম দিলাম। পকেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে দেখিয়ে বললাম, আমি একজন মানবাধিকার কর্মী। সাংবাদিকতাও করি।

আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি? ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, অবশ্যই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আধা ঘন্টা সময় কথা বললেন তিনি। আলোচনার মাধ্যমেই জানলাম, তার নাম আলী ইয়াকিন। দেশের বাড়ি পাকিস্তানের লাহোরে।

দেড় বছর থেকে চাকরী করছেন আবুদাবি এয়ারপোর্টে। মানুষটিকে খুব অমায়িক মনে হলো আমার কাছে। সচরাচর পাকিস্তানীরা বদমেজাজী ও ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়ে থাকে। আলী ইয়াকিনকে সেই তালিকায় ফেলা ঠিক হবে না। তার সাথে আলাপ করে যা জানলাম, তা হলো, ফ্লাইট শিডিউল ছাড়া তিনি আর তেমন কিছুই জানেন না।

ঢুকলাম কফি শপে। নির্ঘুম চোখ, ক্লান্ত শরীর। শরীরে ষ্ট্যামিনা ফিরিয়ে আনতে একমগ মিনি কফি ও একপিছ কেক নিলাম। হাদিয়া ২০+১৬=৩৬ দেরহাম, ৭২০ বাংলাদেশি টাকা। উপায় কী? ঘুরে ঘুরে একদম অন্তপ্রান্তে চলে গেলাম।

হাতে আমার অখন্ড সময়। তাড়া নেই। এয়ারপোর্ট মুছামুছির কাজে যারা আছেন, তারা যে বাঙালিই হবেন, জানা ছিল। একজনের সাথে কথা বললাম। পরিচয় পর্বটা শুরু হল এভাবে- ক্লিনারদের পরণে থাকে খয়েরী শার্ট।

খয়েরী শার্ট পরা একলোক দাঁড়িয়ে আছে আল ফালাহ মানি এক্সচেঞ্জ সাইনবোর্ড লাগানো একটি শপের সামনে। আমতা আমতা করছে। কাছে গিয়ে বললাম, ক্যান্ আই হেল্প ইউ? লোকটি ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকালো শুধু। বললাম, আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি? সে বললো, আমি এখানে কাজ করি। সামান্য বেতন পাই।

মাসে সাড়ে ৮ হাজার। বাংলাদেশি টাকায়। দেশে টাকা পাঠাতে চাই। তিন দিনের মধ্যেই টাকাটা আমার বাড়ি পৌছানো দরকার। আমার বাচ্চা হাসপাতালে।

এখন আমার জানা দরকার এরা তিনদিনে টাকা পৌছাতে পারবে কি না। আমি বললাম, জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছেন না কেন? সে বললো, আমি তো বাংলা ছাড়া কিছুই জানি না। আর যে মেয়ে কাউন্টারে বসে আছে, সে অনেক ভাষাই জানে, কেবল বাংলা ছাড়া। আমি বললাম, নাম কি আপনার? বাড়ি কোথায়? সে জানালো, তার নাম আব্দুর রহিম। ঢাকার গাজিপুরের ছেলে সে।

তাকালাম এক্সচেঞ্জের দিকে। ভোতা চেহারার ফর্সা যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে আমার কাছে চায়না বা কোরিয়ান মেয়ে বলেই মনে হলো। মহিলার সাথে কথা বলে রহিম মিয়ার মুশকিল আসান করে দিলাম। ৩ দিনের মধ্যেই টাকা পাঠানো যাবে। রহিম মিয়া কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানালো আমাকে।

তার কাছ থেকে জানলাম আবুদাবি এয়ারপোর্টে ১৭৮ জন বাংলাদেশি আছে। বিভিন্ন পদে আছে। তবে ১০/১২ জন ছাড়া সবাই ক্লিনার। আমি ভাবলাম মন্দ কি? পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো ঈমানের অঙ্গ। আমার বাঙালি ভাইরা তো ঈমানের মেহনতই করছে।

আবুদাবি লোকাল টাইম বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ইত্তেহাদের পরিবর্তিত ফ্লাইট চেপে বসলাম। ফ্লাইট নং-EY17। যাত্রা করলাম হিথ্রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। এবারের ক্যাপ্টেন সুলেমান মোহাম্মদ। মাইকে স্বাগত জানালেন সবাইকে।

৩৬ হাজার ফিট উপর দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। দুপুরের এক পশলা রোদ এসে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। বাইরে প্রচন্ড রোদ অথচ মনিটর আমাকে জানালো বাইরের তাপমাত্রা মায়নাস ৫৬ ডিগ্রি! রোদের তেজ দেখে মনে হচ্ছে আকাশ বুঝি ফেটে যাচ্ছে। একফোটা বৃষ্টি না হলে আর বুঝি আকাশের আর রক্ষে নেই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো আকাশ বৃষ্টি পাবে কোথায়? বৃষ্টিতো আর আকাশে থাকে না।

বৃষ্টি থাকে মেঘমালায়। আর মেঘমালা থাকে আকাশের অনেক নিচে। এই মুহুর্তে আমাদেরও নিচে। কারণ আমরা এখন অবস্থান করছি মেঘের অনেক উপরে। যদিও আকাশটা অনেক দূরে, তবে দেখে মনে হচ্ছে আকাশটা একদম হাতের লাগালে।

চাইলেই বুঝি স্পর্শ করা যাবে। জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম আমি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। নিচে মেঘেরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটাছুটি করছে। সম্ভবত বাংলাদেশের দিকেই যাচ্ছে।

বৃষ্টি বাদল তো বাংলাদেশেরই নিত্যসঙ্গী। মাঝে মধ্যে আমাদের সামনেও মেঘ পড়ছে। আমরা মেঘ কেটে এগিয়ে যাচ্ছি। আবার কয়েক মিনিট পরেই লক্ষ্য করছি ফকফকা আকাশ। জানালা দিয়ে একটু দূরে নিচের দিকে তাকালাম আমি।

মনে হলো হালকা আকাশী ও ধূসর বাদামী রঙের গাছগাছালীর মাঝে যেন সাদা সাদা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো পাহাড় আবার সমানও নয়। কোনোটা উঁচু কোনোটা নিচু। কোনোটি আবার ত্রিভূজাকৃতির। আবার কখনো মনে হয় যেন ধবধবে সাদা বালির স্তুপ তৈরি করে রাখা হয়েছে।

দৃষ্টি নিবন্ধ করলাম আমার আগে পিছে। সাদা ও ফ্যাকাশে কালারের মানুষই বেশি। নষ্ট পাটের মতো বাদামী কালারের চুল। পিংলা চোখ। খসখসে চামড়া।

দেখলে মনে হয় বেচারীরা দীর্ঘদিন ধরে ধবল রোগে আক্রান্ত। পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। আগেই জানানো হয়েছে ইত্তেহাদ অত্যাধুনিক বিমানগুলোর একটি। চাইলেই উত্তেজক পানীয় পাওয়া যায়। এরা সকলেই এই মওকাটি কাজে লাগাচ্ছে।

তাদের সকলের সামনেই বরফ ভেসে থাকা হুইস্কির গ্লাস অথবা বিয়ারের ক্যান। লন্ডন লোকাল টাইম বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে আমরা গিয়ে অবতরণ করলাম হিথ্রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে টার্মিনাল নং-৪ এ। ...চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।