আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (১৯)


হারানো সে দিনগুলো ৩০ মার্চ মঙ্গলবার বিকেল ৪টা। স্কটল্যান্ড থেকে ফোন করলো তালতো ভাই মনসুর। খোঁজ খবর নিলো। কথা বললো অনেক্ষণ। গতকাল মোবাইল বাসায় ফেলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

এসে দেখি ক্যানিংটাউন থেকে ফোন করেছিলো পাপেল। আতিকুর রহমান পাপেল। ৮ বছর হলো আছে লন্ডনে। স্ত্রী সন্তান সহ। কোনো একদিন, ১৯৯/৯২ সালের দিকে সে ছিলো আমার ছাত্র।

সেই ছাত্রত্ব ও শিক্ষকত্ব ছিলো একটু ব্যতিক্রম। বাদ মাগরিব আতিক এবং আতিকের বড় ভাই সাদেককে নিয়ে পড়ার বিছানায় (টেবিলে নয়) বসতাম। আমার কোলে থাকতো বালিশ, কাঁধে জেনি। তাদের ছোট বোন নাহিদা সুলতানা জেনি। সে তখনও স্কুলে ভর্তি হয় নি।

হবো হবো করছে। সঙ্গত কারণেই সে আমার ছাত্রী ছিল না। আর এই সুযোগটি সে ভালভাবেই নিতো। আজও ভালকরে খুঁজলে আমার হাতে তার চিমটি কিংবা কামড়ের দাগ পাওয়া যাবে। জেনি মাঝে-মধ্যে অবস্থান করতো আমার ঘাড়ে।

ভদ্রমহিলা তখন সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছেন। বসে বসে আমাদেরকে পড়ালেখা সংক্রান্ত মহামূল্যবান গাইডলাইন দিতেন। কথা বলতেন বানান করে করে (প্রায়)। অবশ্য এখন বেশ গুছিয়েই কথা বলেন তিনি। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ ভালই আছেন।

এখন আর কথায় তার সাথে পারা যায় না। তখন আমি তার দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করি। বলি, বেশি কথা বললে সবাইকে বলে দেব আমার কোলে বসে কিভাবে চিমটি কাটতে। তখন বেচারী কিছুটা লজ্জা পেয়ে যান। সাময়িকভাবে ক্ষান্ত হন।

৯২ সালে পড়াতে বসতাম যখন, তখন আমিও কিশোর। পড়ানো বলতে ১৫/২০ মিনিট বসে গল্প-গোজব করা, এই যা। আধাঘন্টার মধ্যেই চাচা (তাদের আব্বা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুশ শহীদ) এসে হাজির হতেন। ইতিমধ্যে বাড়ির উঠানে ২০০ ওয়াটের ৮টি লাইট জ্বলে উঠেছে। এসে বলতেন, পড়ালেখা কেমন চলছে? আমি বলতাম, ভালই।

তিনি বলতেন, তুমি আর কী পড়াবে সেটা আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। তারচে চলো সময় নষ্ট না করে ব্যাডমিন্টন খেলি। সাথে সাথে বাধ্য ছেলেদের মতো আমরা তিনজন উঠে চলে যেতাম উঠানে। তাদের বাসায় চন্দন নামে আরেকটি ছেলে থাকতো। সকলে মিলে মধ্যরাত পর্যন্ত খেলা।

তারপর কোনোদিন গোছল-টুছল করে আবার কোনোদিন বিনা গোছলে হাত মুখ ধুয়ে চলে আসতাম খাবার ঘরে। খাবার ঘর মানে সরাসরি রান্নাঘরে। প্রায়ই ভাত তরকারী বেড়ে দেয়ার মহান কাজটি করতেন চাচা নিজেই। আর এই ঘটনা যেদিন ঘটতো, সেদিন আমাদের অবস্থা হতো কাহিল। পেটে জায়গা আছে কি নেই, খেতে ইচ্ছে করছে কি না, সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতো না।

খেতেই হবে। ‘আর পারবো না’ বললে ভাতের সাথে ধমকও খেতে হতো। তখন আমাদের অবস্থা হতো করুণ! আর সেই মর্মান্তিক সময়ে আমাদের উদ্ধারকারী ফেরেশতার মতো আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন চাচি ও ফুফু। আমাদের পেছনে রাখতেন বড় একটি থালা। আমরা ভাত তরকারী সাপ্লাই করে দিতাম পিছনে।

তারা সেগুলো সরিয়ে নিতেন। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হতো ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজটি... সেই আতিক, গত রাতে ফোন করে আমাকে না পেয়ে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে মোবাইলে। ম্যাসেজের ভাষা, “ও স্যার! গেলা কই?” রাতে আর তাকে ফোনে পাইনি। আজ কলব্যাক করলাম। সে বললো, আছেন কোথায়? আমি বললাম, আমি কোথায় আছি সেটা জরুরী না।

তোমার সাথে আমার কোথায় দেখা হতে পারে সেটাই বলো। সে বললো, সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি। আপনি কোথায় আছেন বলেন, আমি এসে নিয়ে যাবো। আমি বললাম, তোমাকে এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে কেন? এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। তুমি কি ভেবেছো আমি এখনো কিছুই চিনি না? হেসে ফেললো সে।

বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কোথায় আসবো বলেন? আমি বললাম, তুমি ব্রিকলেন চলে আসো। আমি তোমাকে ওখানেই দেখা করবো। সে বললো, ওকে। যতই লম্বাচুড়া কথা বলি না কেন. এ পর্যন্ত আমি কিন্তু হোয়াইটচ্যাপেল, ব্রিকলেন এবং পেকহামই চিনি। ৩০ মিনিটের মধ্যেই ব্রিকলেন পৌছে গেলাম আমি।

পাপেলও চলে এলো। তারপর সে তার গাড়ি করে ঘুরলো আমাকে নিয়ে। প্রায় দুই ঘন্টা সময় দিলো আমাকে। গাড়ি করে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলো। আতিকের সাথে কথা বলে অনেক তথ্য পেলাম আমি।

এদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। আতিক আমাকে জানালো, বাংলাদেশি রাজনীতির অশুভ সকল উপকরণই নাকি এদেশে আছে। বিশেষত আওয়ামীলীগ, বিএনপি’র মারামারি-কাটাকাটির রাজনীতি এদেশে, কড়া আইনের শাসনের দেশেও চলছে। আমি মনে মনে বললাম, ...যায় বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। আতিক আমাকে জানালো, এই কিছুদিন আগে, বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায় কার্যকর হবার দিন কয়েক পূর্বে কমার্শিয়াল রোডে আওয়ামীলীগের যুক্তরাজ্যস্থ কেন্দ্রীয় অফিসটিতে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়।

বিএনপি থেকে বলা হয় এটা আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফসল। আওয়ামীলীগ থেকে এ ব্যাপারে দুটি রেওয়ায়াত পাওয়া গেছে। একটি হল, এটা বিরোধীদল বিএনপি’র কান্ড। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এটা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সাঙ্গপাঙ্গ ও বেনিফিশিয়ারীদের কাজ। আতিককে আমি এখানকার বাঙালি ছেলে মেয়েদের অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম।

সে আমাকে জানালো, এক কথায় অবস্থা করুণ! বিশেষত: বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হামলেট এলাকার অবস্থা বেশি ভয়াবহ। এখানকার বাঙালি ছেলেমেয়েদের নিত্যসঙ্গী হল মদ, গাজা ও হেরোইন। অশিক্ষিত বাবা মা’দের সচেতনতার অভাবেই তাদের সন্তানদের এই অধঃপতন। ছেলে মেয়ের লাগাম শক্ত করে ধরা হয়নি। যেমন ইচ্ছে ফ্রি ষ্টাইল চলতে সুযোগ দেয়া হয়েছে।

বলতে গেলে অশিক্ষিত বাবা মা’দের সচেতনতার অভাবেই তাদের সন্তানদের এই অধ:পতন। ছেলেমেয়ে মডার্ণ হচ্ছে, বাবা মা তো খুশি। নিজেরা অ.ই.ঈ পড়েন নি। তার পুত্র কন্যা তোতাপাখির মতো ইংরেজি বলছে! গর্বে তো তাদের অনেকের পা-ই মাটিতে পড়েনি। এখন সন্তান যখন একটু বড় হয়ে গেছে, সাতার শিখে ফেলেছে, তখনই বুঝছে কত ধানে কত চাল।

১২/১৩ বছরের মেয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটাচ্ছে। বাবা মা অসহায়। কিছু বলতেও পারছেন না। মেয়েকে একটু যে বকা দেবেন, সে ক্ষমতাও নেই। যদি মেয়েকে এ জন্য ধমকও দেন, আর সে যদি পুলিশে কমপ্লেইন করে, তাহলে পুলিশ এসে উল্টো অই মা-বাবাকে ধরে নিয়ে যাবে।

আমি মনে মনে বললাম, হায়রে সভ্যতা!! পাপেল আমাকে জানালো, এদেশের স্কুলে পড়া না পারলে বা দুষ্টুমী করলে শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। এটাকে বলা হয় ডিটেনশন। ডিটেনশনের মানে হলো, ক্লাস শেষ হবার পর আরো এক ঘন্টা আটকে রাখা হবে। তারপর কোনো একটি ট্রপিক দিয়ে বলা হবে এ বিষয়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে লিখতে। বেচারী ১ ঘন্টা দাঁড়িয়ে কষ্ট করে লিখার পর টিচার সেটা পড়েও দেখবেন না।

তার ১ ঘন্টার কষ্টের লেখাটি তারই চোখের সামনে ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলা হবে। তারপর ছুটি। বখাটে ছেলে-মেয়েরা এই সুযোগটি নেয়। অশিক্ষিত যে বাবা মা’রা সবকিছু বুঝেন না, তাদেরকে ধোকা দেয়া যায় খুব সহজেই। বন্ধুর সাথে বা বান্ধবীর সাথে পুরো বিকেল কাটিয়ে এসে বাসায় বলে স্কুলে ডিটেনশনে ছিলো।

বাবা মা-রা বলেন, ও আচ্ছা, ব্যাস। অভার অল লন্ডনের অবস্থা কেমন? প্রশ্নটি করার পর আতিক আমাকে বললো, একদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতে হয় এখন অবস্থা অনেক ভাল। এক সময় অবস্থা নাকি এমনও ছিলো, যখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সামনে লেখা থাকতো Dog and indian are not Alowde। কুকুর এবং ইন্ডিয়ান ঢুকার অনুমতি নাই। উল্লেখ্য যে, ইন্ডিয়ান বলতে বাঙালিদের বুঝানো হতো ...চলবে
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।