আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (৩১)


দুর্গতি অব স্টুডেন্ট ৫ এপ্রিল সকাল ১১টা। ঘরে বসে কথা বলছিলাম শাহ কয়েস’র সাথে। কয়েস ভাই সাত বছর ধরে আছেন এদেশে। অনেক জিনিষ জানবার আছে তার থেকে। তিনি নিজে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘৃণা করেন মনে প্রাণে। আওয়ামীলীগ বিএনপি দুই দলকেই তিনি সমান দায়ী মনে করেন দেশের অধ:পতনের জন্য। তার সাথে ২ ঘন্টা কথা বলে আমি যে ব্যাপারগুলো বের করলাম, তা হলো, ব্রিটেনে আইনের শাসন মারাত্মক। আর এটা তো আমিও দেখতে পাচ্ছি। পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু।

সারা জীবন কথাটিকে মিথ্যে ভেবে এসেছি। যুক্তরাজ্যে গিয়ে প্রথম আমার জানা হলো পুলিশকে কেন বন্ধু বলা হয়। আপনি যেখানেই থাকেন, যে অবস্থাতেই থাকেন, ডাকলেই পুলিশকে আপনার পাশে পাবেন। আর পুলিশকে ডাকাও একদম সহজ। আপনি আপনার ফোন থেকে শুধু ৯৯৯ ডায়াল করবেন, আপনার অবস্থান বলবেন, ব্যস, পুলিশ হাজির।

আপনি নতুন কেউ। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। পুলিশকে কল করুন। পুলিশ আপনাকে রাস্তা বলে দেবে। যদি তারা মনে করে এই মদন রাস্তা বলে দেয়ার পরও একা একা যেতে পারবে না, তাহলে তারা গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বাংলাদেশের পুলিশ ভাইজানদের কেউ কি শুনছেন? সরকার পরিচালনায় যারা থাকেন, তাদের মাঝেও দেশপ্রেম ও জনগণের চিন্তা থাকে। দেশের মানুষ ভাল আছে কি না, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না-খেয়াল করে। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনকে মাঝে মধ্যে ট্রেনে পাওয়া যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও এই কাজটি করতেন। একবার টনি ব্লেয়ার ট্রেন সার্ভিস ঠিকঠাক আছে কি না, জানার জন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই ট্রেনে চেপে বসেছিলেন।

টিকেট চেকার এসে প্রধানমন্ত্রীকে স্যালুট করে বললো, স্যার, টিকেট? ব্লেয়ার তো লা জবাব! তিনি তো আর টিকেট করে উঠেন নি। তিনি টিকেট দেখাতে পারলেন না। টিটি ৫০ পাউন্ড জরিমানার রিসিপট হাতে ধরিয়ে আরেকটি স্যালুট দিয়ে চলে গেলো। ব্লেয়ার সাহেব রিসিপট পকেটে রাখলেন। তারপর তার ব্যক্তিগত আইনজীবির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জরিমানার টাকা জমা করালেন।

তাদের দেশে আইনের শাসন আছে। আমাদের দেশেও আমরা আইনের শাসনের কথা বলি। কিন্তু প্রায়োগিক দৃষ্টিতে কত ফারাক! এই কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের ছেলে ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে পুলিশ তাকে রাস্তায় অনেক সময় আটকে রাখে। আটক থাকা অবস্থায় উপর-নিচ কোথাও থেকে একটি ফোনও আসে নি। নো তদবির।

পুলিশ ফাইন করে ছাড়ে। আমাদের দেশের যে কোনো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভারের শালা'র ক্ষেত্রেও কি এটা কল্পনা করা যায় ? সবচে’' অবাক করা ঘটনাটি ঘটেছে গত বছর। ব্রিটেনের নাম্বার ওয়ান পার্সন হলেন রাণী। তার ব্যবহৃত গাড়ি মার্কা মারা। দেখলেই চেনা যায়।

রাণী গেছেন রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে। রাস্তায় নির্ধারিত পার্কিং লেনে গাড়ি পার্ক করেছেন। তবে চিহ্নিত এরিয়ার কয়েক ইঞ্চি বাইরে চলে গেছে গাড়ির সামনের অংশ। রাস্তায় দায়িত্বরত মোবাইল পুলিশ রাণীর গাড়িতে অবৈধ পার্কিং এর কারণে জরিমানার টিকেট লাগিয়ে চলে যায়। ব্যাপারটি মিডিয়ায় চাউর হয়ে গেলে খুঁজে বের করা হয় অই পুলিশকে।

এত বড় সাহস! রাণীর গাড়িতে টিকেট দেয়! তাকে খুঁজে বের করে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি জানতে এটা রাণীর গাড়ি? সে বললো, হ্যা, জানতাম তো। জানবো না কেন? তারপরও তুমি টিকেট দিয়েছো? হ্যা। তোমার এত বড় সাহস? প্রশ্ন সাহসের না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব পালনের। তুমি জানো এ জন্য তোমার চাকরী চলে যেতে পারে? গেলেও তো আমার কিছু করার নেই।

আমাকে তো আমার ডিউটি করতে হবে। আমাকে যখন ট্রেনিং দেয়া হয়, তখন শেখানো হয়েছে কোন্ অপরাধের শাস্তি কী? জরিমানা কতো? তখন কোনো বিভাজনের কথা বলে দেয়া হয়নি। বলা হয়নি জনগণের জন্য এই আইন। রাণীর জন্য শিথিল। সুতরাং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমার কাছে রাজা রাণী বা জনগণের মাঝে কোনো পার্থক্য করার সুযোগ নেই।

অতঃপর আবেগ ও ভয়ের উর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করতে পারার জন্য সংশ্লিষ্ট অই পুলিশকে রাষ্ট্রীয় এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আর আমার দেশে...থাক, সকলেরই জানা। দুপুর ২টা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেলাম বাংলা টাউনে। সেখান থেকে পত্রিকা কিনে গেলাম আলতাব আলী পার্কের দিকে।

এই পার্ক ব্রিকলেনের একদম নাকের ডগায়। চলে গেলাম সেদিকে। উদ্দেশ্য, কোনো তালেবুল ইলিমের সাথে মোলাকাত করা। আমাকে নিরাশ হতে হলো না। উস্কো-খুস্কো চুলে উদাস ভঙ্গিতে পার্কে পায়চারি করতে দেখলাম একটি ছেলেকে।

চেহারায় ভারি বিষন্নতা! শ্যামলা মতন ২২/২৩ বছরের ছেলে। কাছে গিয়ে কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বললাম- আপনি বাঙালি, রাইট? ছেলেটি তাকালো আমার দিকে। অনেক দিন পর কোনো আপনজনকে কাছে পেলে মানুষ যেভাবে তাকায়, ঠিক সেই ভঙ্গিতে। বললো, হ্যা। আপনি কি আমাকে চেনেন? বললাম, আমরা বাঙালিরা সবাই সবাইকে চিনি।

নাম কি আপনার? বাড়ি কোথায়? ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, আমার নাম রুমান মিয়া। কবে এসেছেন? সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে। স্টুডেন্ট ভিসা তো? জ্বি। কোন্ কলেজ? স্টাম্পফোর্ড কলেজ। এরপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, থাকেন কোথায়? কাজটাজ পেয়েছেন কিছু? সে জানালো, এখনো পার্মানেন্ট কিছু পায় নি।

মাঝে মধ্যে ছেড়াভাঙা কিছু পেলে করছে, না পেলে নাই। থাকে ফরেস্টগেট একটি মেসে। এক রুমে দশজন। এক রুমে দশজন থাকে কীভাবে? জিজ্ঞেস করে জানলাম রুমটির সাইজ এমন যে, এক সাথে ৩/৪ জনের বেশি থাকা যায় না। তারা ৫ জন করে থাকে।

দিনে ৫জন, রাতে ৫ জন। যে ৫ জন রাতে ঘুমায়, তারা ভোর বেলা বেরিয়ে যায়। বাকী ৫ জন সারাদিন থাকে, সন্ধ্যেবেলা বের হয়। কথার এই পর্যায়ে আমি যখন খাতা-কলম বের করে পয়েন্ট টুকছি, সে জিজ্ঞেস করলো, লিখছেন কেন? কী করেন আপনি? টুকটাক লেখালেখি করি। পত্রিকায়? হ্যা।

সে বললো, লিখে কী লাভ হবে? আমি বললাম, হতে পারে আপনাদের দুর্গতির কথা জেনে সিরিয়ালে থাকা অন্যরা আর না-ও আসতে পারে। সে বললো, পত্র-পত্রিকায় কি কম লেখালেখি হয়েছে? টেলিভিশনেও তো সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তারপরও তো কাজ হয়নি। আমরা এসেছি। আপনি কী করে ভাবলেন আপনার লেখায় কাজ হয়ে যাবে? আমি ভাবলাম, তাই তো।

কী হবে লিখে। একবার যে ছেলে (অথবা মেয়ে) লন্ডন শরীফ জিয়ারত করার নিয়ত করে ফেলেছে, তাকে আটকে রাখার সাধ্য কার? আমি রুমান মিয়াকে বললাম, দুপুরে খেয়েছেন কিছু? সে মাথা নিচু করে ফেললো। আমি নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। পকেটে হাত দিয়ে আবিস্কার করলাম আমার সাথেও অতিরিক্ত পয়সা নেই। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, পড়ালেখা কেমন চলছে? সে বললো, পেটে ভাত না পড়লে পড়ালেখা কেমন চলতে পারে, তাতো বুঝতেই পারছেন।

অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। পার্কের ঘাসের উপর জটলা মতো বসে থাকা ভাইজানদের দেখিয়ে বললাম, ওরাও কি স্টুডেন্ট? সে বললো, ম্যাক্সিমামই স্টুডেন্ট। ওদের অবস্থা কী? অবস্থা ভাল থাকলে কি আর এভাবে বসে ফাউল আড্ডা দিত? রুমান মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম একা একা। তারপর ফিরে এলাম বাসায়। এরই মধ্যে আজ একটি কাণ্ড ঘটালাম আমি।

নতুন একটি মোবাইল সিম কিনে ফেললাম। ভ্যাকটন সিম। দাম ৫ পাউন্ড। অবশ্য সাথে ৫ পাউন্ডের টকটাইম আছে। এর মানে সিমটি বিলকুল ফ্রি।

রাত সাড়ে ৯টায় আবার বেরিয়ে গেলাম। ঘাপটি মেরে ঘরে বসে থাকার তো কোনো মানে হয় না। হোয়াইটচ্যাপেল ইসলামী ব্যাংক অব ব্রিটেন’'র সামনে আবিস্কার করলাম এক ভিক্ষুক মেয়েকে। কাছে গেলাম তার। দেখেই চেনা যাচ্ছে ইংলিশ মেয়ে।

২৫/২৬ হবে বয়স। কিংবা কে জানে আরো বেশিও হতে পারে। জোয়ান-বুড়ো, সবগুলোর চামড়াকেই বাইরে থেকে আমার সমান মনে হয়। মেয়েটি সামনে কাউকে দেখলেই আওয়াজ দিচ্ছে, প্লিজ, গিভ মি সামথিং... আমি কাছে গিয়ে বললাম, এই মেয়ে, নাম কি তোমার? স্টিয়ানা। ঘর কোথায়? লিভারপুল ষ্টিট।

কাজ না করে ভিক্ষে করছো কেন? সে চুপ করে রইলো। বাসায় কে কে আছে তোমার? সে নিশ্চুপ। আমি বুঝে গেলাম ঘটনা। অযথা প্রশ্নের জবাব দিতে সে আগ্রহী নয়। ৫০ পেন্স এর একটি কয়েন ছুড়লাম তার হাতে থাকা ভিক্ষের মগে।

তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। বললো, থ্যাংক য়্যূ। বললাম, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি মেয়ে। সে বললো, লিভ টুগেদার করতাম। বয়ফ্রেন্ড সবকিছু বিষয় সম্পত্তি কৌশলে তার নামে নিয়ে নিয়েছে।

তাই ভিক্ষে করতে হচ্ছে। আমি বললাম, যদ্দুর জানি, তোমাদের সরকার তো অসুস্থ ও বেকারদের খাবার দেয়। তাহলে তোমাকে ভিক্ষে করতে হবে কেন? সে জবাব দিল না। চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নের জবাব সে দিতে চাচ্ছে না।

এদেশে অনেকেই ভিক্ষে করে। নেশার টাকা ফুরিয়ে গেলেও ভিক্ষে করে কেউ কেউ। এই মেয়েও সেই দলের কিনা কে জানে। অবশ্য দেখে সেটা মনে হয় না। অন্তত তাকে আমার খাটি ভিক্ষুকই মনে হচ্ছে।

এসে উদয় হলো তার এক ছেলে বন্ধু। সাথে একটি কুকুর। কুকুরটি স্টিয়ানার। বন্ধুর সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। সে কুকুরের গায়ে হাত বুলাতে লাগলো।

চুমু খেলো কুকুরকে। তারপর সে তার কুকুরের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। যেন সন্তানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আমি একটু দূরে সরে দাড়ালাম। কুকুরটি আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।

ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ব্যাপারটি খেয়াল করে ষ্টিয়ানা বললো, ডন্ট ওরি। সি ইজ গুড গার্ল। বুঝলাম এটি একটি কুকুরী। যদিও শরীর-স্বাস্থ্য দেখে সেটা বুঝার উপায় নেই।

কিংবা কে জানে, এদেশের কুকুরগুলোর সাইজ এমনই হয় কি না। খেদমত তো আর কম করা হয় না এদের পেছনে। স্টিয়ানা তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালো। আমার দিকেও বাড়িয়ে দিল সিগারেটের প্যাকেট। আমি বললাম, নো থ্যাংকস।

তার কাছ থেকে চলে এলাম। বললাম, ওকে, বাই। সে বললো, টেক কেয়ার, সি ইউ। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তাজুল ভাই ফোন করে খোঁজ নিলেন। রাত ১২টায় ফোন করলেন আতাউর ভাই।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর ৭ তারিখ ফ্রি আছি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, আপনার জন্য সব সময়ই ফ্রি আছি। বললেন, তাহলে কথা থাকলো ৭ তারিখ আসছো। আমি সেভাবেই প্রোগ্রাম গুছাবো। তুমি তৈরি থেকো, আমি তোমাকে এসে নিয়ে যাবো।

আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। ...ক্রমশ
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।