স্মৃতির অরণ্যে
আজ ৪ এপ্রিল। সারাদিন ঘরেই কাটালাম আজ। তাজুল ভাই আমার জন্য এক সপ্তাহের নতুন বাসা যোগাড় করেছেন। হোয়াইট চ্যাপেলের একদম কাছে। শর্ডইচ।
পায়ে হেটে ৫ মিনিটের পথ। আজ ওখানে গিয়ে উঠবো। বের হলাম আসরের নামাজের পরে। সাথে তাজুল ভাই ও ইউসুফ। মাগরিবের নামাজ আদায় করা হলো সাউথ ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদে।
নামাজের পর ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ইমাম মাওঃ রওনক আহমদ। বালাগঞ্জ উমরপুরে বাড়ি। আমি আমার নাম বললাম। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না।
দেখাগেল তিনি আমার চৌদ্দগোষ্ঠিকেই চেনেন। বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
তাজুল ভাই নিয়ে গেলেন ওয়েস্ট মিনিষ্টার। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এরিয়ার। টেমসের পাড়ে অত্যন্ত শৈল্পিক সৌন্দর্যে তৈরি করা হয়েছে পার্লামেন্ট ভবন।
ভবনের সামনেই আলী আমজদের ঘড়িরচে’ আরো বড় আরো উঁচু একটি ঘড়ি। আমাদের সিলেটের আলী আমজদের ঘড়ির সাথে সেই ঘড়ির পার্থক্য হলো, অই ঘড়ি চলে। আর আমাদের ঘড়ি ঘরে আজ আর ঘড়িই নেই। ( ইদানিং আবার লাগানো হয়েছে)
টেমস পাড়কে এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, শুধু হাটতেই ইচ্ছে করে। আমার আর বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না আমাদের সাইফুর রহমান সুরমা পাড়কে সুন্দর করে সাজানোর এই আইডিয়াটি কোত্থেকে পেয়েছিলেন।
মন থেকে এই লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতা বেরিয়ে এলো। সাইফুর রহমানের মতো মানুষ শতাব্দিতে দু’পাচজনের বেশি জন্মায় না। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা সিলেটবাসী একজন সাইফুর রহমানকে পেয়েছিলাম।
হেটে হেটে চলে এলাম লন্ডনের চোখের সামনে। এই চোখের কেতাবী নাম Eye’s of London| ।
নামের শানেনুজুল হচ্ছে, এটায় চড়ে উপরে চলে গেলে পুরো লন্ডন শহর দেখা যায়। রিং এর মতো গোলাকার করে তৈরি করা হয়েছে এটি। দূর থেকে তাকালে স্থিরই মনে হয়। অথচ কাছে গিয়ে ভাল করে তাকালে বুঝা যায় এটি স্থির নেই। ঘুরছে।
এত স্লো ঘুরছে যে, একবার ঘুরে আসতে সময় নিচ্ছে ১ ঘন্টা। এটায় চড়ে লন্ডন শহর দেখতে ৩০ পাউন্ড হাদিয়া লাগে। ৩০ পাউন্ড খরচ করে লন্ডন দেখার কোনো আগ্রহ পেলাম না। বিনে পয়সায় যা দেখছি, তাই বা কম কিসে।
লন্ডনের চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে চলে এলাম আমরা শর্ডইচ, আমার এক সপ্তাহের নতুন ঠিকানায়।
এখানে থাকে সুমন। সিলেট গোলাপগঞ্জের ছেলে। সুমন হলো আমার ব্যবসায়িক পার্টনার সৌদি প্রবাসী খলিল ভাই’র ছোট ভাই। আবার সুমনের ইমিডিয়েট বড় ভাই জিয়াউর রহমানকে আমি ডাকি জিয়াচ্ছা। এখন সুমনকে কী ডাকবো ভেবে পেলাম না।
বাসায় পুরুষ মানুষ মাত্র দু’জন। একজন হলো সুমন, দ্বিতীয়জন হলেন বালাগঞ্জ উসমানপুরের শাহ কয়েস আহমদ। সুমন এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। ৩/৪ মাস হলো। কয়েস ভাই আছেন ৭ বছর থেকে।
কয়েস ভাই ও সুমনের সাথে বসে আড্ডা চললো রাত ২টা পর্যন্ত। আলোচনার নির্ধারিত কোনো বিষয় ছিলো না। বাংলাদেশ, লন্ডন তথা গোটা পৃথিবী নিয়েই চললো অগোছালো আলাপ-আলোচনা।
এর মধ্যে রাত ১২টার দিকে ফোন করলেন চাচাতো ভাই মুজিব। বললেন, কিরে! আজ না তোর আসার কথা ছিলো? আম্মাতো অপেক্ষা করছেন!
আমি বললাম, স্যরি ভাইয়া, আজ তো আর আসতে পারবো না।
দু’ একদিন পরে আসি?
তিনি বললেন, তোর এই দু’একদিন কবে যে শেষ হবে আল্লাই জানে। আচ্ছা আসার আগে ফোন করিস।
আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে।
ফোন রাখার পরই ফোন করলেন তাজুল ভাই। খোঁজ খবর নিলেন।
নতুন ঠিকানায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করলেন।
আমি বললাম, ঠিক আছি। সমস্যা নেই।
ঘুমোতে যাবার আগে ব্যাগ খুললাম। কাপড় চোপড় বের করা দরকার।
দেখলাম ব্যাগে অ্যাপেল, কমলা, জুস, চিপস ইত্যাদি ইত্যাদি বোঝাই করা। সন্দেহ নেই এটা আপার কান্ড। বোনরা এমনই হয়। আজ অনেকদিন পর আরো একজনের কথা স্মরণ করে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমার একজন প্রিয় মানুষ ছিলো।
আমার সুখ-দুঃখ শেয়ার করার সাথী। ৮ বছর আগে সে বড়বেশি স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। চলে গেছে না ফেরার দেশে। মানুষটি ছিলো আমার বড় বোন। বড় আদরের বোন ছিলো আমার।
আমার সর্ব সাকুল্যে সাতটি বোন ছিলো। দুইটি ছিলো বড়, পাঁচটি ছোট। আমার সবচে’ বড়বোন খুব ছোটবেলাতে, আমার জন্মের আগেই মারা যায়। আমার ছোট্ট দু’টি বোনও মারা যায় শিশুকালে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, আমার চারটি বোনকে পেয়েছি।
এদের মধ্যে আমার ইমিডিয়েট অগ্রজ বোনটি, নাম ছিলো শিপা, তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পাঁচটি সন্তান রেখে সেও চলে যায় ২০০১ সালে।
আমি আমার একটি বইয়ের উৎসর্গে লিখেছিলাম, আমার ছোট তিনটি বোনের জন্য যে মমতা আছে আমার, তার সম-পরিমাণ মমতা আমি অনুভব করি বড়টির জন্য। এ জন্য একদিন তিন বোন আমাকে চেপে ধরেছিলো। ওরা বলেছিলো-
আচ্ছা আমরা কি তোমাকে ভালবাসি না?
আমি বললাম, তা হবে কেন?
তোমার প্রতি আমাদের কোনো মায়া-মমতা নেই?
আমি কি সেটা বলেছি নাকি?
বাকী রেখেছো কোথায়?
আমি বললাম, ঘটনা কী?
তারা বললো, এই যে তুমি লিখলে, আমরা তিনজন সমান তোমার বড় বোন। এর মানে কি? মানুষ ভাববে না আমরা তিনবোন তোমাকে কোনো খাতির যত্ন করি না।
এজন্যই আমাদের জন্য তোমার ভালবাসাও কম।
ঘটনা পরিস্কার হলো আমার কাছে। আমি বললাম, আসলে ঘটনা তো তা-না। তোরা আমার জন্য ততটুকুই করছিস, বোনরা ভাইয়ের জন্য যতটুকু করতে পারে।
তাহলে?
তাহলে কী
তুমি অকথা লিখলে কেন?
আমি বললাম, স্যরি বাবা, ভুল হয়ে গেছে।
আপনারা তিনজনে মিলে মেহেরবাণী করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর কখনো এমন হবে না।
সরি-টরি বলে কোনো রকমে পার পেয়েছিলাম সেদিন।
অবশ্য সেদিন তাদেরকে যে কথা আর বলা হয়নি, তা হলো, তারা তিনজন আমাকে ভালবাসা দিচ্ছে, বিনিময়ে আমার কাছ থেকে ভালবাসার আশা করছে এবং পাচ্ছেও। কিন্তু অই বোনটি আমার আমাকে শুধু দিয়েই গেছে।
বিনিময়ে নেয়নি কিছু। আমি দেবার সময় পাইনি। তাছাড়া আরো একটি ব্যাপারও আছে। থাক, সেটা আর বলছি না। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়ে লাভ নেই।
আপা’র দেয়া ফলমূল ফ্রিজে রেখে দিলাম। সাথে পান-সুপারীও দিয়েছেন। সেগুলোর হক আদায় করা হলো। নাশিতাকে খুব মিস করতে লাগলাম। এই ক’দিনে সে-ই আমাকে সবচে’ বেশি আপন করে নিয়েছিলো।
ছোট্ট মেয়ে, পান-সুপারীর সাথে তার তেমন করে পরিচয়ও নেই। খাদ্যটা কেমন, জীবনে খেয়েও দেখেনি। তবুও আমার পান খাওয়া দেখে সে বুঝতে পেরেছিলো এটি একটি সুখাদ্য। অন্তত আমার একটি প্রিয় খাদ্য। তাই কিছুক্ষণ পর পরই, আমি যখন লিখতে বসি, এসে পাশে দাঁড়াতো, বলতো, মামা, পান এনে দিই?
স্কুল ও ঘুমের সময় ছাড়া, আমি যতক্ষণ বাসায় থাকতাম, সে আমাকে সঙ্গ দিতো।
কিছু সময় কোলে তো কিছু সময় কাঁধে। আমার মাথার দু’'এক গাছি সাদা চুল নিয়ে তো সে ছিলো মহাচিন্তিত। যখন এক সপ্তাহের জন্য চলে আসছি, তখন সে ঠোট-মুখ শুকনো করে বললো, মামা, তুমি চলে যাচ্ছো?
আমি বলেছি, না-মা, একটু কাজে বাইরে যাচ্ছি। দুই তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো। তখন সে হেসে বলেছে, দ্যাট্স অ’কে।
তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হ্যান্ডশেক করবার জন্য।
...চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।