আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (২৫)


হাটছি ইস্ট লন্ডন মসজিদের দিকে। আবিষ্কার করলাম পেটে ক্ষিধে চেপেছে। বাসা থেকে ফোন করে তাগাদা দেয়া হয়েছে দুপুরের খাবার খেতে যাবার জন্য। বলেছি চলে আসছি। কিন্তু বুঝতে পারছি মাগরিবের আগে যেতে পারবো না।

আমি যে খোরাক পাচ্ছি, সেটা তো বাসায় গেলে পাবো না। তবুও কিছু তো খাওয়া দরকার। বাঙালি মানুষ আমি। খুঁজে খুঁজে গিয়ে ঢুকলাম ব্রিকলেন বনফুলে। গিয়ে বসতেই ১৮/১৯ বছরের শ্যামলা মতন ছিপছিপে একটি ছেলে কাছে এসে সালাম দিয়ে বললো, ভাই কেমন আছেন? আমি তাকালাম তার দিকে।

ভাবতে চেষ্টা করলাম তাকে আমি চিনি কি না। মনে করতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, ভালো। সে বললো, আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি আরিফ। সিলেট জামেয়ায় নূরানীতে (প্রাইমারী) পড়তাম।

২০০৩ সালে। মাঝে মধ্যে তার প্রতিষ্টানে আমার যাওয়া হতো। তার কথামতোই সে তখন বাচ্ছা ছেলে। সঙ্গতকারণেই তাকে আমার চিনতে পারার কোনো কারণ নেই। তবুও ছেলেটির আগ্রহের দিকে লক্ষ্য করে চিনতে পারার ভঙ্গিতে বললাম, ও আচ্ছা, তুমি আরিফ।

তারপর আরিফ, কী অবস্থা? আছো কেমন? সে বললো, ভাল। স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছি। সপ্তাহে দুই দিন কলেজে যাই। রয়েল লন্ডন কলেজ। এটি আমার চাচার দোকান।

কাজ করি। আমি বললাম, ভাল। দোকানে তার আরেক কলিগকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কি? সে বললো, রাসেল। বাড়ি? সিলেট, শিবগঞ্জ। দেশে কোথায় লেখাপড়া চলতো? এম.সি কলেজে।

অনার্স করছিলাম। আমি রাসেলকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? এসে কেমন লাগছে? সে বললো, ভাই এই জীবনে অনেক পাপ করেছি। সবগুলোর শাস্তি হলো এখানে আসা। কত ভাল ছিলাম! আমি বললাম, কেন? সমস্যা কী? সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো, আপনি বলেন না সুবিধাটা কী? থমকে গেলাম আমি। আমার টেবিলে কালো মতন আরেকটি ছেলে বসে আছে।

সে আরিফ ও রাসেলের সাথী। একই কলেজে পড়ে। নাম আলী হুসেন। বাড়ি মৌলভীবাজার কুলাউড়া উসমানপুর গ্রামে। তিনমাস হলো এসেছে।

এখনো কাজ পায়নি। বললাম, তুমি চলো কিভাবে? থাকো কই? সে বললো, চাচার (?) বাসায়। কোনো সমস্যা হচ্ছে না? সে কৃত্রিম হাসির চেষ্টা করে বললো, জি না। তার এই হাসিটিকে আন্তরিক মনে হলো না। যাকে বলে ইচ্ছার বিপরীতে জোর করে হাসার চেষ্টা।

তার হাসিটি যে আন্তরিক ছিলো না, সে ‘ভাল আছি’ বললেও সে যে মোটেও ভাল নেই, একটু পরেই সেটা প্রকাশ পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে এদেশে এসে? সে বললো, ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা খরচ করে এসেছি। তা না হলে তো আজই দেশে চলে যেতাম। আমি ঠোঁটকাটার মতো পাল্টা প্রশ্ন করলাম, চাচার বাসায় আছো, ভাল আছো। তাহলে চলে যাবে কেন? ভদ্রলোক আর জবাব দিলেন না।

এমন সম্পূরক প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বেচারা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাকে বিব্রত করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কাটা গায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বে হলেও নুনের ছিটা দিয়েছি। ঠিক হয়নি।

হোয়াইটচ্যাপেল থেকে বাস নং সেভেনটি এইট চেপে বসলাম। বাসায় যাওয়া দরকার। সেই সবে বেরিয়েছি। পেকহাম’র কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তখন ফোন করলেন তাজুল ভাই।

বললেন, কী খবর। সারাদিন বাইরে বাইরে? খাওয়া দাওয়া লাগবে না? নাকি রাণীর মেহমান হয়ে গেলেন? আমি ফাজলেমী করে বললাম, রাণী খাওয়ানোর জন্য খুব জোর করেছিলেন। আজ তাকে সময় দিতে পারি নি। দু'’মিনিটের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাচ্ছি। বাসায় পৌঁছে ওয়েস সাহেবকে যথারীতি ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত দেখা গেল।

দেশ জাতির খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। গ্রহ-নক্ষত্রের খোঁজ খবরও নিতে চেষ্টা করছেন। তাজুল ভাইকে সারাদিনের কারগুজারী দিলাম। ভাত নিয়ে আসতে বলার পর আমি বললাম, সন্ধ্যাবেলা তো একমাত্র মোরগই খাওয়া দাওয়া করে। অবশ্য রমযান মাস হলে ভিন্ন কথা।

আমি খেয়ে এসেছি। আজকের আকাশটা অনেক পরিস্কার। রোদ ও মেঘের লোকচুরি খেলাটাও আজ কম। ঠান্ডাও মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে। ৮ ডিগ্রী।

আকাশে সুর্যটা দেখা যাচ্ছে তবে রোদে যৌবন নেই। শীতের মওসুম বিদায় নিচ্ছে। এদেশে ৮ মাসই শীত থাকে। মাত্র মাস চারেক থাকে সামার। আর বছর ধরে এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে ইংলিশরা।

দলবেধে ঘুরে বেড়ায়। লাফালাফির চূড়ান্ত করে। তিন চার দিন আগে তাপমাত্রা ছিলো ৪ ডিগ্রি। রাস্তায় বেরিয়ে শীতে কাঁপছি আমি। তখনও এদেশের মেয়েদের সর্ট কাপড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।

হাটুর অনেক উপরে স্কাট, স্যান্ডু গেঞ্জি গায়ে। বুক খোলা হালকা জ্যাকেট। ঠান্ডা নামক অনুভূতিটা তারা কীভাবে জয় করে ফেলেছে কে জানে! দেখলে মনে হয় অভাবের সংসার। বেচারীরা এই শীতেও কাপড়ের অভাবে ঠান্ডা খাচ্ছে। সিলেট দরগাহ মসজিদের ইমাম মরহুম মাওঃ আকবর আলী (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ।

দুনিয়ার হাওয়া-বাতাস খুব একটা বুঝতেন না। বুঝতে চাইতেনও না। তিনি যখন লন্ডন গিয়েছিলেন, আর তার সামনে যখন এমন স্বল্প বসনা মেয়েরা পড়েছিলো, তখন তিনি নাকি আফসোস করে বলেছিলেন, এরা কত গরীব! কাপড়টা কিনতে পারছে না। এদের গরীবী দূর হওয়ার জন্য দো’আ করা দরকার। আজ ইমাম সাহেব বেঁচে থাকলে তাকে বলতাম, হুজুর, ওরা আজ আরো গরীব হয়ে গেছে।

ওদের জন্য দোআ’র পরিমাণটা বাড়িয়ে দেয়া দরকার। আমি মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশের আবহাওয়া এদেশে দিয়ে দিলে কেমন হতো অবস্থা। একে তো নাচের বুড়ি, সাথে পাইতো ঢুলের বাড়ি। তখন গায়ে কাপড়ই রাখতো কি না সন্দেহ। হয়ত দেখা যেত কেউ কেউ গরমের অজুহাতে প্রথম জন্মদিনের পোশাকেই ঘুরাঘুরি করছে।

অবশ্য এত কিছুর পরও এদেশের মেয়েরা ইংলিশ হোক বা বাঙালি, বসে নেই। তারা তাদের কাজ কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সে আইন পাশ হয়ে গেছে মেয়েরা ইচ্ছা করলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করতে পারবে। এটা তাদের স্বাধীনতা। ব্রিটিশ মেয়েরাও সরকারের কাছে দাবি তুলেছে, তাদেরও এই সুযোগ থাকা দরকার।

এটা হলো সভ্য দেশের সভ্যতা! ভাগ্যিস আমরা সভ্য নই। সিগারেট খাওয়ার একটা নিয়ম আছে। যারা চেইন স্মোকার, তাদের কাছ থেকে জেনেছি, সিগারেটের ধোঁয়া নাকি টান দিয়ে পেটের ভেতরে নিয়ে যেতে হয়। তারপর সেই ধোঁয়াকে পেটের ভেতর কয়েকবার তোয়াফ করিয়ে মুখ দিয়ে নাক দিয়ে এবং হয়তবা উপর নিচের সম্ভাব্য আরো কোনো রাস্তাঘাট থাকলে সেখান দিয়ে বের করে দিতে হয়। এদেশের বাঙালি এবং ইংলিশ মেয়েরা ছেলেদের সাথে সমান তালে পাল্লা দেয়।

তারাও রাস্তাঘাটে সিগারেট টানে। তবে তাদের অনেকের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যে আনাড়িপনা লক্ষ্য করার মতো। দেখলেই বুঝা যায়, তারা অনেকেই খাওয়ার জন্য খাচ্ছে না। স্মার্টনেস প্রকাশের জন্য এই সুকর্মটি করছে। নিজের ক্ষতি হয় হোক, পিছিয়ে থাকলে তো হবে না।

নিজের নাক কাটা গেলে যাক, অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারা যাক আর না যাক, ন্যূনতম সমান হতে পারাও তো একটা কথা। ব্রিটিশ মেয়েরা, ব্রিটিশ বাঙালি মেয়েরা, ছেলেদের থেকে নিজেদের কোনো অংশেই কম ভাবে না। একটি ব্রিটিশ গল্প। (কাল্পনিক) একটি ছেলে একটি মেয়ে। মেয়েটি আবার একটু বেশি সুন্দরী।

তাকে দেখে ছেলের মাথা গরম হয়ে গেল অথবা শরীর। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে। আচমকা মাঝ রাস্তায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বসলো। হঠাৎ ছেলের ওই আচরণে মেয়ে রেগে গেল প্রচন্ডভাবে। রাগারই কথা।

এটা তো আর মগের মুল্লুক না। আবার সেদেশের মেয়েরা তো আর আবহমান বাংলার লাজুক বাঙালি মেয়েদের মতন না যে, চড় খেয়ে নিরবে হজম করে বসে থাকবে। তারা চড়ের জবাবে ঘুসি দিতে জানে। মেয়েটিও প্রতিশোধ নিতে দেরি করলো না। সেও রেগে-মেগে গিয়ে আহত বাগিনীর মতো জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে।

তারপর ছেলের থেকে বেশি সময় নিয়ে এবং বেশি জুরে প্রতিশোধের চুমোটি খেলো। চরম প্রতিশোধ নিলো মেয়ে!! বলছিলাম মেয়েদের সিগারেট খাওয়ার গল্প। এদের মধ্যে যারা পেশাদার সিগারেটসেবী, তারা শুধু সিগারেটেই সন্তুষ্ট থাকছে না। মদ, গাঁজাও তাদের নিত্য সঙ্গী। একটু বয়স যাদের হয়ে গেছে পঁয়ত্রিশ প্লাস, তেমন বয়সের মহিলাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একহাতে সিগারেট অন্যহাতে কুকুরের গলায় ঝুলানো রশির লাগাম।

কুকুরের’চে বিশ্বস্ত বন্ধু আর তাদের নেই। কুকুর নিয়েই তাদের উঠা বসা, চলা ফেরা এবং বিছানায় যাওয়া। বিছানায় যাওয়া মানে যতভাবে বিছানায় যাওয়া যায় আর কি? এমনকি মৃত্যুর সময় তারা তাদের বিষয় সম্পত্তিও কুকুরের নামে উইল করে দিয়ে যায়। আর দেবেই না কেন? বয়স আঠারো হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা ফেলে চলে যায়। কিন্তু কুকুর কখনো ফেলে যায় না।

চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।