আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (২৪)


প্রথমেই গেলাম ব্রিকলেনের ঘাড়ে শ্বাস ফেলা দূরত্বে কোয়াকার ষ্ট্রিটে সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকা অফিসে। ওখানে কাজ করেন বিশ্বনাথের কাইয়ূম ভাই। সুরমা অফিসে গিয়ে কাইয়ূম ভাইয়ের টেবিলে চলে গেলাম। তার সাথে এর আগে আমার পরিচয় ছিলো না। আমি গিয়ে আমার নাম বলতেই চিনে ফেললেন।

বসিয়ে চায়ের কথা বললেন। ধাঁধায় পড়ে গেলাম আমি। এক নামে চিনে ফেলার মতো লেখক তো আমি হয়ে উঠি নি। কাইয়ূম ভাই চিনলেন কিভাবে? ঘটনা কী? আমার পেটের ভেতর কিলবিল করতে থাকা এই প্রশ্নটির জবাব আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন, তাজুল ভাই আপনার কথা বলেছেন।

তারপর বলুন কী খবর? দেশের অবস্থা কী? আমি বললাম, দেশের অবস্থা তো আপনি আমার’চে কম জানেন বলে মনে হয় না। কাইয়ূম ভাই বললেন, তাজুল ভাই বলেছিলেন সাহিত্য প্রোগ্রাম করছেন? সেটার অবস্থা কী? আমি বললাম, হবে। আগামী ১১ এপ্রিল ডেট ঠিক করা হয়েছে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি তো আছি। প্রোগ্রাম কী করে সুন্দর করা যায়, সেটা তাজুল ভাই’র সাথে আলাপ হবে।

সুরমা অফিস থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম হোয়াইট চ্যাপেল ইউরোবাংলা পত্রিকার অফিসে। পেয়ে গেলাম সিনিয়র সাংবাদিক বদরুজ্জামান ভাইকে। তাঁর সাথে এর আগেও আমার দেখা হয়েছে। ২৫শে মার্চ রেনেসাঁর সাহিত্য প্রোগ্রামে। দেশের মিডিয়া নিয়ে অনেক্ষণ কথা হলো জামান ভাই’র সাথে।

তিনি সিলেটে তার অনেক কলিগের খোঁজ খবর নিলেন। আমি তাকে ১১ তারিখের প্রোগ্রামের দাওয়াত দিলাম। ইউরো বাংলা অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা উপরে চলে গেলাম। উপর তলায় সপ্তাহিক বাংলাদেশের অফিস। দেখা করলাম পত্রিকার সম্পাদক শেখ মুজ্জাম্মেল হোসাইন কামাল’র সাথে।

আমি আমার একটি বই দিলাম তাকে। তিনি যথেষ্ট খাতির যত্ন করতে চেষ্টা করলেন। পত্রিকা পাড়া থেকে বেরিয়ে ব্রিকলেন ওল্ড মন্টেগো ষ্ট্রেট এর মোড়ে দেখা হলো একটি ছেলের সাথে। জিজ্ঞেস করে জানলাম তার নাম জুয়েল। আব্দুল গাফফার জুয়েল।

হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের ছেলে। ষ্টুডেন্ট ভিসায় আমদানি। তার হাতে লিফলেট। সে একটি কোম্পানীর লিফলেট বিতরণ করছে। কোম্পানীর নাম The easlend express. Cargo and Couriar ।

প্রতিষ্ঠানটি কুরিয়ার সার্ভিসের কাজ করে। স্লোগানও চমৎকার। একটি লিফলেট হাতে নিয়ে দেখলাম, তাতে লেখা- “আর নায় কোনো মাত মাল পাঠাও সব জাত” আব্দুল গাফফার জুয়েল মহা উৎসাহে ‘সবজাত’ মাল পাঠানোর লিফলেটটি বিতরণ করছে। আর এর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে আমার সাথে। আমি তার পেটের ভেতর থেকে খুচিয়ে খুচিয়ে যে কথাগুলো বের করলাম, তা হলো, তারা তিনজন এক সাথে একই রুমে থাকে।

তিনজনই বেকার কোম্পানীর বিশ্বস্থ সদস্য। তার এক সাথীর নাম আবদাল। একই এলাকায় বাড়ি। অন্যজন সিলেট বিয়ানীবাজারের। জুয়েল উচ্চশিক্ষার (!) জন্য ভর্তি হয়েছে হোয়াইট চ্যাপেল কলেজে।

এসেছে জানুয়ারি ২০১০ সালে। খেয়ে না খেয়ে কাটাচ্ছে দিন। ১৫ দিন হলো লিফলেট বিতরণের এই কাজটি করছে। সপ্তাহে ৬০ পাউন্ড বেতন। আমি তার সাথীদের অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম।

সে জানালো, তার সাথী আবদাল আজই একটি কাজ পেয়েছে। এর আগে ফরেষ্টগেইটের পাশে একটি রেষ্টুরেন্টে ১ সপ্তাহ কাজ করেছিলো। বেতন না দিয়েই বের করে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আবদাল আজ থেকে যে কাজটি পেয়েছে বললেন, সেই কাজটা কী? সে জানালো, এক বৃদ্ধা মহিলার দেখাশুনা করা। অই মহিলার কেউ নেই।

আবদাল মিয়া অই বুড়ির খেদমত করে সপ্তাহে ৯০ পাউন্ড পায়। তৃতীয় জন এখনো কাজ পায়নি। জুয়েলকে আমি অন্যান্য ছাত্রদের অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম। সে আমাকে একটি রিয়েল গল্প শোনালো। বললো, গত ৪ দিন আগে কাজ শেষ করে রুমে যাচ্ছি।

ফরেষ্ট গেইটের দিকে হেটে সামনে এগুচ্ছি। ষ্টেফনিগ্রীণ রোডে এক ছেলে সামনে এসে সাহায্য চাইলো। আমার পকেটে আছে সবেধন নিলেমনি ৪ পাউন্ড। সে বললো, ভাই, সারাদিন পানি ছাড়া কিছু খাইনি। ছেলের কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হলো।

আমি আমার আর্থিক অবস্থা ভুলে গিয়ে তাকে ২ পাউন্ড দিয়ে দিলাম। তারপর ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে কথা বললাম তার সাথে। ছেলেটির নাম কী বলেছিলো মনে নেই। ঢাকার ছেলে। ষ্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে।

৪ মাস কোনো কাজ পায়নি। নিকট আত্মীয় বলতেও কেউ নেই। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই ভিক্ষে করছে। গল্প শুনে আমি মনে মনে বললাম, বাঙালি ছেলেরা কত মহান হয়ে গেছে। ভিক্ষে করে জীবন চালাচ্ছে আর পড়ালেখা করছে।

পড়ালেখার প্রতি তাদের কত টান! জুয়েল যেখানে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিতরণ করছিলো, তার একটু দূরে একই কাজ করছে আরো একটি মেয়ে। আমি এগিয়ে গেলাম তার কাছে। বুঝতে সমস্যা হলো না বাঙালি মেয়ে। স্টুডেন্ট ভিসার ফজিলত। কাছে যেতেই সে তার লিফলেট ধরিয়ে দিলো।

(Aston) him and her মনে হচ্ছে সেলুনের বিজ্ঞাপন। শ্যাম্পু টেম্পুও হতে পারে। বললাম, বাঙালি তো? সে বলল, জ্বি। আপনার দেশ কোথায়? যশোর। স্টুডেন্ট? হ্যাঁ।

থাকেন কোথায়? ভাই’র বাসায়। আপনার নাম....? নাম জিজ্ঞেস করতেই সে চুপ করে রইলো। আমি যখন তার পাশের ছেলের সাথে কথা বলছিলাম, তখন পয়েন্টগুলো ডায়রীতে লিখছিলাম। মেয়েটি সম্ভব সেটা লক্ষ্য করেছে। সে বললো, নাম জেনে কি করবেন? লিখবেন? দেশবাসীকে জানাবেন বাংলাদেশি মেয়েরা রাস্তায় হকারের মতো লিফলেটিং করছে! আমি বললাম, আপনি রাগ করছেন কেন? নাম বলতে না চাইলে বলতে হবে না।

সমস্যা নেই। আপনি কি আপনার অবস্থা একটু বলবেন? ঝাঁঝালো কন্ঠে সে জবাব দিলো, তাতে কী করবেন? সমস্যা হলে সমাধান করে দিয়ে যাবেন? আমি বললাম, প্লিজ... সে বললো, দেখুন, বিরক্ত করবেন না। আমাদেরকে মনিটর করা হয়। ওরা যদি দেখে আমি কাজ ফেলে কারো সাথে অযথা কথা বলছি, তাহলে আমার চাকরী শেষ। আমি বললাম, ঠিক আছে।

আপনি আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিন। আমি আর বিরক্ত না করে চলে যাবো। সে কপালে ভাজ ফেলে ভুরু কুচকে তাকালো আমার দিকে। মহা বিরক্তির প্রকাশ। এর মানে সে আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতেই আগ্রহী নয়।

মেয়েটিকে আর ঘাটালাম না। খামাখা বেচারীর চাকরী খেয়ে লাভ কী? যে প্রশ্নটি আমি তাকে করতে চেয়েছিলাম, তা হলো, দেশে মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে নিম্ন শিক্ষায় শান্তিতে ছিলে নাকি বর্তমানে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষায়? বিকেল ৪টা মতন বাজে। চলে গেলাম আলতাব আলী পার্কের দিকে। উদ্দেশ্য স্টুডেন্টদের অস্থায়ী কার্যালয় এই পার্কে তাদের কর্মকান্ড একটু দেখা। হঠাৎ সামনে আবিষ্কার করলাম একজনকে।

২৬/২৭ হবে বয়স। ছেলেটি সামনে এসে কষ্টার্জিত ইংরেজিতে বললো, ক্যান্ য়্যু টেল মি হোয়ার ইজ জব্ সেন্টার? আমি তাকে খাঁটি বাংলায় জবাব দিলাম, দেখে তো বাংলাদেশি মনে হচ্ছে। রাইট? সে বললো, জ্বি। আপনার বাড়ি? আমি বললাম, সিলেট। আমি মৌলভীবাজারি।

মৌলভী বাজার কোথায়? কুলাউড়া সদর। আপনার নাম কিন্তু জানা হয়নি? জাহেদুল ইসলাম জুয়েল। স্টুডেন্ট ভিসা? জ্বি। আপনি? আমি ভিজিটে। এক মাসের জন্য।

তার কন্ঠে বিস্ময়! যেন এক মাসের জন্য লন্ডন আসা ছোটখাটো একটি অপরাধের মতো। সে আমাকে বললো, কবে এসেছেন? সাক্ষাতকার নিতে চেষ্টা করছি আমি। আর উল্টো আমাকেই জেরা করছে সে। আমি বললাম, ২১ মার্চ। সে বললো, আপনার জানামতে কোনো কাজের সন্ধান আছে? আমি বললাম, ভাই, আমি মাত্র দশদিন হল আসলাম।

এই ক’দিনে তো এখনো পুব-পশ্চিমই চেনা হয় নি। যখন নামাজে দাঁড়াই, মনে হয় উল্টো দাঁড়িয়েছি। পূর্ব-উত্তরদিকে এর আগে নামাজ পড়া হয়নি তো। আমার কাছে কাজের খবর থাকবে কীভাবে? সে বললো, আপনি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। কী করেন আপনি? আমি বললাম, আমি গুছিয়ে কথা বলি এই তথ্যটি জীবনে প্রথম শুনলাম।

অবশ্য বন্ধু-বান্ধবদের কেউ কেউ বলে আমি কিছুটা গুছিয়ে নাকি লেখি। সে বললো, আপনি সাংবাদিক? বললাম, অনেকটা তাই। সে বললো, তাহলে তো আপনার অনেক জানাশুনা। একটু দেখবেন। বড় সমস্যা আছি।

যদি কিছু পান, দয়া করে আমাকে জানাবেন। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। সে চলে গেল। আমি ভাবলাম কাজ না পেয়ে ছেলেটি কত বেশি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে যে, আমাকে বলে যাচ্ছে কিছু পেলে তাকে যেন বলি অথচ মোবাইল নাম্বারটি পর্যন্ত দিয়ে যাবার কথা তার মনে থাকে নি। আলতাব আলী পার্কের ভেতর ঢু মারলাম।

ছেলেরা বসে বসে সিগারেট ফুকছে। কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। ভাইজানদের চোখ আগুনের মতো লাল। সিগারেটের পূর্বে আরো কড়া কোনো ডোজ পড়েছে হয়তো। এই অবস্থায় মেজাজ মর্জি নরম্যাল নাও থাকতে পারে।

উল্টো যদি বিপদে পড়ি। একা মানুষ। কী দরকা! ...চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।