তালেবুল ইলিম সমাচার
ব্রিটিশ বড়ই চালু মাল। সবকিছুই তাদের প্লানওয়াইজ চলে। আমাদের উপমহাদেশ শাসন করে গেছে তারা দু’শ বছর। জোর করে। অবশ্য দখলদারিত্বের স্লোগান দিয়ে আসেনি তখন।
এসেছিলো ব্যবসার নামে। প্লান ছিলো তাদের সুদুরপ্রসারী, দীর্ঘ মেয়াদী। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে ছিলো তারা।
একদিন, ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে উৎখাত করার মধ্যদিয়েই আমাদের উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলো তারা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এত শক্তভাবে ওরা চেপে বসেছিলো আমাদের ঘাড়ে, দু’শ বছর লেগেছে ঘাড় থেকে তাদের নামাতে।
ইংল্যান্ড একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সেদেশে মানুষের রয়েছে অঢেল স্বাধীনতা। যার যা ইচ্ছে, করতে পারে। যেখানে খুশি যেতে পারে। বাধা দেয়া হয় না।
মানবাধিকারের তীর্থ ভূমি ধরা হয় ব্রিটেনকে। কিন্তু কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছে ব্রিটেনের স্বাধীনতা অঢেল হলেও অবাধ নয়। বাধ আছে। আমার কাছে ঘুড়ির মতোই মনে হয়েছে।
ঘুড়ির স্বাধীনতাও কম না।
ঘুড়ি লেজ নাচিয়ে ঘুরে বেড়ায় আকাশে। সে ভাবে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে সে। তার আর নাগাল পায় কে! ঘুড়ি জানেনা নাটাই নামক একটি বস্তু আছে। সেটা হাতে নিয়ে কলিমুদ্দি বসে আছে গাছ তলায়। তার যখন আর ভাল্লাগবে না, তখন নাটাই বলতে শুরু করবে।
ইচ্ছে হোক আর না হোক, ঘুড়িকে চলে আসতে হবে হাতের মুঠোয়। ইংল্যান্ডের সরকারও নাটাই হাতে রেখে ছেড়ে দেয় সবাইকে। করো যার যা খুশি। চলো যার যেমন ইচ্ছে। সমস্যা কী? নাটাইতো আমার হাতেই আছে।
বড়ই চালু মাল এই ব্রিটিশ জাতি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারার চমৎকার দক্ষতা রয়েছে তাদের। তারা আমাদের মতো না। তাদের দেশে নেতার পরিবর্তন হয়। নীতির পরিবর্তন হয় না।
ব্লেয়ার, ব্রাউন, ক্যামেরন, নামগুলোই পরিবর্তন হয় শুধু, কাম ঠিকই থাকে। আর এ জন্যই কোনো সমস্যাকে তাদের কাছে সমস্যা মনে হয় না। সব বেমারেরই অষুধ তাদের জানা আছে।
সা¤প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক ধ্বস নেমেছিলো। আর এই বিশ্বমন্ধার প্রভাবে সবচে’ বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ইউরোপ-আমেরিকা।
ব্রিটেনের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম! কী করা যায়?
কিন্তু অই যে! অষুধ তাদের জানা আছে বললাম। সুন্দর করে একটি আযান দিলো তারা। তারা জানে দক্ষিণ এশিয়ার, বিশেষত বাংলাদেশের মানুষ একটু ধর্মপ্রাণ। আযান শুনলে মসজিদে ছুটে যায়। তারা জানে তাদের আযান শুনলে মুসল্লির কোনো অভাব হবে না।
আযান তারা এর আগেও দিয়েছে অনেক। ফলও পেয়েছে। এবারেও পেলো। আযানে এত বেশি মাধুর্যতা থাকে যে, আমার বাঙালি ছেলেরা পতঙ্গপালের মতো ছুটে যায় তাদের কাছে। তারা তাদের আযানের কথাগুলোয় পরিবর্তন আনে সময় বুঝে।
এর আগে তারা আযান দিয়েছিলো ওয়ার্ক পারমিটের, ওয়ার্কিং হলিডে মেকারের। ভালই ফায়দা পেয়েছিলো। তবে তাদের এবারের আযানটি ছিলো স্মরণকালের সবচে’ সহজ ও সুন্দর আযান। স্টুডেন্ট ভিসার আযান। ‘লালা’র মা’র ঢালা’ খুলে দেবার মতো খুলে দিলো বর্ডার।
ইংরেজি ছোট হাতের অক্ষরগুলো না দেখে লিখতে পারে না; এমন বাঙালিরও খাহেশ জাগলো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের। বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ মানুষ লাইন ধরলো ব্রিটিশ এ্যাম্বেসিতে। হাজার হাজার লোক পাড়ি দিতে সক্ষম হলো যুক্তরাজ্যে। একেক জনের পকেট থেকে গড়ে ৫ লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিলো ব্রিটিশরা। সঠিক পরিসংখ্যান হচ্ছে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড।
আমার দেশের শত শত কোটি টাকা চলে গেলো তাদের পকেটে। গত ৫ বছরে ব্রিটেনের বাঙালিরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে টাকা পাঠিয়েছিলো দেশে, ৫ মাসের মধ্যেই সেই টাকা তারা ফিরিয়ে নিয়ে গেলো সুদে আসলে। মন্ধার প্রভাব কাটিয়ে উঠলো তারা। আর আমার হুজুগে বাঙালিরা উড়ে গিয়ে মান্দা ভিড় করতে লাগলো লন্ডনের অলিতে গলিতে। দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলো এক টুকরো করুণার কাঙাল হয়ে।
এক মাসের এই সফরে মোট ৬৪ জন ছেলে-মেয়ের সাক্ষাত পেয়েছি আমি। স্টুডেন্ট ভিসায় পাড়ি জমানো হাজার হাজার ছেলে মেয়েদের ভিড়ে আমি কথা বলেছি তাদের সাথে। একজনও আমাকে বলেনি, ‘ভাল আছি’। একজনও। এভরি সিঙ্গুল ওয়ান ভোগছে অনুশোচনায়।
জীবন যে কত কঠিন, হাড়ে হাড়ে ঠের পাচ্ছে তারা।
সকলের কাহিনী লিখতে গেলে বই এর কলেবর বেড়ে যাবে অনেক। আলোচনার বাঁকে বাঁকে তাদের কয়েকজনের কথা উঠে আসবে লেখায়। তবে যাদের কথা বলা হবে আর যাদের কথা বলা যাবে না অথবা যাদের সাথে আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি, সকলের প্রতি আমাদের সমান সমবেদনা থাকবে।
২ এপ্রিল শুক্রবার।
সকাল ১১টা। সেভেনটি এইট বাস চেপে ২০ মিনিটে চলে গেলাম হোয়াইট চ্যাপেল। জুমার নামাজ আদায় করতে ঢুকলাম ব্রিকলেন জামে মসজিদে। নামাজে এসে হাজির হলেন আমার বালাগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর ভাই। নামাজের পর মফুর ভাই’র সাথে দেখা হলো।
আমাকে সামনে দেখে কিছুটা চম্কে উঠলেন তিনি। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, কবে এসেছো?
বললাম, এক সপ্তাহ হবে।
স্টুডেন্ট ভিসা?
জ্বি না। ভিজিটে।
উঠেছো কোথায়?
আত্মীয়’র বাসায়, পেকহাম।
মফুর ভাই বললেন, বাসায় চলো।
বললাম, আজ না মফুর ভাই। আছেন তো কয়েকদিন। আরেকদিন আসবো।
তিনি তাঁর কন্ট্রাক্ট নাম্বার দিলেন। বললেন, ফোন করো।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
অবশ্য এর পরে আর তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বড় বড় প্রোগ্রাম নিয়ে।
আর আমি আমার ছোট ছোট প্রোগ্রাম। আমি যখন বাসায় ছোটমণিদের নিয়ে আড্ডা দেই, তখন টেলিভিশনে দেখি মফুর ভাই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহতারামা দিপুমণির প্রোগ্রামে বসে আছেন।
নামাজের পরে মসজিদেই পেয়ে গেলাম সিলেটের পরিচিত অনেক বন্ধু বান্ধব ও মুরব্বীদের। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বালাগঞ্জের রখই মিয়া। আমার আব্বার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু।
সালাম জানিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। বললেন,
তুমি রশীদ?
হ্যাঁ চাচা। কেমন আছেন?
ভাল। তুমি কবে আসলে?
এইতো।
সপ্তাহ খানেক।
কয়েক মিনিট হালকা কথাবার্তা বলে আরো অনেকের সাথে দেখা করে বেরিয়ে এলাম।
মসজিদ থেকে বাইরে বেরিয়ে পেয়ে গেলাম সুমন ভাইকে। ব্রিকলেনের বাসিন্দা সুমন। দেশের বাড়ি সিলেট শহরের টিলাগড়ে।
অধুনালুপ্ত মাসিক ব্যতিক্রম পত্রিকার অফিসে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি আমরা এক সাথে। আজ তৃতীয়বারের মতো দেখা হলো সুমন ভাই এর সাথে। বললো, আজ আর না চলবে না। বাসায় চলুন। শুধু চা খাবেন?
আমি বললাম, এই ভর দুপুরে ভাত খাওয়ার টাইমে একজন মেহমানকে শুধু চা’র দাওয়াত করা কি ঠিক হচ্ছে?
হেসে উঠলো সুমন।
বললো, আচ্ছা বাসায় চলুন তো।
অনেক কাজ দেখিয়ে বাসায় যাবার তারিখ পেছালাম। বললাম, বাসায় গিয়ে অন্য দিন খাবো। আজ এখানেই কিছু খাইয়ে দিন।
বললো, কী খাবেন বলুন?
আমি যথারীতি পানের কথাই বললাম।
হেসে উঠলো সুমন। বললো, পানের আগে কী?
আমি বললাম, আগে পিছে আর কিছু নেই। পান এমন এক খাদ্য, যার আগে পিছে আর কিছু থাকতে হয় না। পান বাংলা ব্যাকরণের অব্যয় পদ না যে, অন্যের সাহায্যে নিয়ে দাঁড়াতে হবে!
সুমন ভাই’র সৌজন্যে ফ্রি পান খেলাম একটা। তিনি আরো দুটি সাথে দিয়ে দিলেন।
বেরিয়ে আসলাম সুমন ভাই’র কব্জা থেকে।
...চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।