আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (২১)


ব্রিটেনে ইসলামফোবিয়া ৩ মার্চ ২০১০। দুপুর ১২টা। কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে বসলাম। ব্রিটেনের বাংলা পত্রিকা। হাতে আজ অখন্ড অবসর।

২ ঘন্টা খুটিয়ে খুটিয়ে পত্রিকা পড়লাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তাজুল ভাই’র সাথে প্রোগ্রামের টুকিটাকি নিয়ে আলোচনা করলাম। তরঙ্গ সাহিত্য পরিষদ যুক্তরাজ্য আমার একক গ্রন্থ প্রদর্শনীর আয়োজন করছে। ১১ই এপ্রিল রোববার। স্থান হোয়াইটচ্যাপেল ডেভেন্যান্ট সেন্টার।

আমি ব্রিটেনে যাবার আগেই তাজুল ভাই আমাকে এই প্রোগ্রামের কথা জানিয়েছিলেন। আর আমি গিয়েই পৌঁছার ৬ দিনের মাথায় কুরিয়ারে করে দেশ থেকে আমার কয়েক’শ বই নিয়ে যান সেখানে। আয়োজক কমিটির সাথে আমি নিজেও কাজ করছি। আমি তো এমন বড় কোনো লেখক না যে, দেশ বিদেশে আমার লক্ষ লক্ষ ভক্ত পাঠক থাকবে যারা আমার নামে ফানাফিল্লাহ হয়ে ঝাপিয়ে পড়বে। বিলেতের মাটিতে আমার বন্ধু-বান্ধবরা আমার সম্মানে একক গ্রন্থ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন।

যতটুকু আমার প্রাপ্য নয়, তারচে’ বেশি সম্মান তারা দিচ্ছেন আমাকে। এই অবস্থায় আমি বসে বসে কৃতজ্ঞতার তসবীহ জপলে তো হবে না। সঙ্গতকারণেই তাদেরকে আমি আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে লাগলাম। যদিও সাহায্য করার খুব একটা ক্ষমতাও নেই আমার। সাহায্য মানে তাদের সঙ্গে সঙ্গ দেয়া আর কি? বিকেল ৩টায় বার্মিংহাম থেকে ফোন করলো ছোটভাই নূরুল আমিন।

খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ফোন করা। বকরতি এই কাজটি সে এর আগেও দু’দিন করেছে। সে বললো, কী ব্যাপার রশীদ ভাই! আপনাকে টিভিতে দেখলাম, সরাসরি কবে দেখবো? আমি বললাম, মানে কী? আমাকে টিভিতে দেখেছো, এর মানে কী? টিভিতে তো এখনো কোনো প্রোগ্রামই হয় নি। সে বললো, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের কী একটা প্রোগ্রামে যেন আপনাকে দেখলাম। চ্যানেল আই’'র নিউজে।

আমি বললাম, ও আচ্ছা। মনে পড়লো ২৫শে মার্চ রাতে রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিসের সাহিত্য সভায় এনটিভি ও চ্যানেল আই’'র ক্যামেরা ছিলো। নুরুল আমিন বললো, বার্মিংহাম কবে আসছেন? আমি বললাম, দেখি, ১৫ তারিখের পরে। আমি তাকে ১১ তারিখ সাহিত্য প্রোগ্রামের আমন্ত্রণ জানালাম। সে বললো, আমি অবশ্যই আসবো রশীদ ভাই।

খোদা হাফেজ। আমিও বললাম, খোদা হাফিজ। ভাল থেকো। দুপুর ১টা। প্রথমেই ঢু মারলাম যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা পত্রিকা ‘জনমত’ এর অফিসে।

ওখানে কাজ করেন বন্ধু ফায়সাল আইয়ূব। দীর্ঘদিন দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ফায়সাল ভাই আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। বললেন, রশীদ ভাই? আমি কি সত্যি দেখছি? কিছু বললাম না। হাসলাম শুধু।

বললেন, কবে এলেন? বললাম, এই তো, এক সপ্তাহ হলো। চা-টা খাওয়ালেন। দুপুরে তার সাথে লাঞ্চ করার জন্য জোরাজুরি করলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মুসলেহ উদ্দিন’র সাথে। মুসলেহ ভাই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন আমাকে।

কাজের ব্যস্ততার মাঝেও অনেক সময় দিলেন। ফায়সাল ভাই আমাকে তাদের পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে যত বড় মাপের একজন লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তার ধারে কাছেও আমি নেই। জনমত অফিস থেকে বেরিয়ে এসে তাজুল ভাই’র সাথে ঢুকলাম হোয়াইট চ্যাপেল মাইলেন্ড রোডে ‘রহিম ব্রাদার্স ক্যাশ এন্ড কারি’তে। বিশাল দোকান, সুপার মার্কেট। মালিক বালাগঞ্জের জনাব হাজি সিদ্দেক আলী লাকি।

এখানে পেয়ে গেলাম লাকি সিদ্দেক সাহেবের ছোট ছেলে হাকিমকে। ১৮ বছর পর হাকিমের সাথে দেখা হলো। কিশোর হাকিমের সাথে পরিচয় ছিলো। যুবক হাকিমের সাথে নতুন করে পরিচয় হলো। সে ড্রিংক্স অফার করলো।

অন্যদিন এসে খাওয়ার কথা বললাম। বললাম আজ শুধু পান খাইয়ে দাও। পান খেয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। হাকিমের সুপার মার্কেটে দেখা হলো স্টুডেন্ট ভিসায় আসা এক ছাত্রের সঙ্গে। সে পিঁয়াজের বস্তা এগিয়ে দিলো, গাড়ি পর্যন্ত।

হাটার ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে হালকা কথা বলতে চেষ্টা করলাম। নাপিতের কাজই তো হলো কোথাও নখের কোণা পাওয়া যায় কি না খুঁজে ফেরা। ফর্সা মতন ছেলেটির বয়স হবে ২২/২৩। নাম জাহেদুল ইসলাম। মৌলভীবাজার কুলাউড়া চৌধুরী বাজারের ছেলে।

এখানে কাজ করে সপ্তাহে ১২ ঘন্টা। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? সে এক কথায় জবাব দিলো, ভাল নেই। ভাল নেই কেন? কাজ তো পেয়েছেন। আর কাজ... কত পান এখানে? সপ্তাহে ৭০ পাউন্ড। থাকা খাওয়া নিজের।

আমার হাতে সময় নেই। সময় তার হাতেও নেই। চলে এলাম আমরা। রাত ৯টা ৩০ মিনিট। বাংলা পোষ্ট পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এবং ভয়েস ফর জাষ্টিস এর জেনারেল সেক্রেটারী জনাব আবু তাহের চৌধুরী সাহেবের সাথে বসার কথা রয়েছে।

যোগাযোগ করলাম তাঁর সাথে। তিনি বললেন, আমি বেথনাল গ্রীণ আমার পত্রিকা অফিসে রয়েছি। ৩০ মিনিটের মধ্যে বাসায় চলে আসবো। আপনি ১০টায় বাসায় চলে আসুন। বাসার লোকেশন দিলেন।

বাসায় যাওয়ার পর প্রথমেই তিনি আমাকে বড়ভাইসূলভ মমতায় আপন করে নিলেন। বললেন, এখানকার সবগুলো বাংলা পত্রিকায় আপনার আসার সংবাদ ও এককপি করে ছবি পাঠিয়ে দেয়া উচিৎ ছিলো। আমি মাথা নিচু করে বললাম, সেটার দরকার ছিলো না তাহের ভাই। তিনি বললেন, আরে! আপনি একজন..... লেখক। আপনার তিনটি বই পড়েছি আমি।

পত্রিকায় আপনাদের মতো মানুষের নিউজ যাবে না তো কার যাবে? তাছাড়া আপনার ছবিসহ যোগাযোগের নাম্বার দিয়ে দিলে আপনার অনেক আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব আপনাকে সহজে খুঁজে পেতো। পকেটে ছবি থাকলে একটি ছবি দিন। আমি আমার পত্রিকায় নিউজ করবো। আমি বললাম, স্যরি তাহের ভাই। ছবিতো পকেটে নেই।

বললেন, দেশ থেকে কি আপনার বইগুলো এসে পৌঁছে গেছে? বললাম, জ্বি। তাহলে দেরি করা ঠিক হবে না। তাজুল ভাইকে বলুন কালই সাহিত্য প্রোগ্রামের ডেট এবং হল্ কনফার্ম করে ফেলতে। আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার বলার দরকার নেই।

তাজুল ভাই’র সাথে আমিই আলাপ করবো। প্রায় ১ ঘন্টা কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। আজ একাই ঘুরছি। এই ক’দিন কতটুকু রাস্তাঘাট চিনলাম, তার একটা পরীক্ষাও নিচ্ছি। নিজে নিজে।

চিন্তা নেই। রাস্তা হারিয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। তাজুল ভাইকে ফোন করে বলবো, আমি হারিয়ে গেছি। আমাকে খুঁজে বের করুন। কীভাবে খুঁজে বের করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।

তাহের ভাই’র ঘর থেকে বেরিয়ে অনুভব করলাম প্রচন্ড ঠান্ডা। হাত পা জমে যেতে লাগলো আমার। পায়ে মোজা পরার পরও। গায় কোটের উপর অভারকোট পরার পরও। শীতে কাঁপছি আমি।

অথচ এই শীতেও আল্লার বান্দাবান্দিরা স্বল্প বসনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! ঠান্ডা থেকে আত্মরক্ষায় আমি যখন বুক কলারের বুতাম চেপে ধরছি, তখন স্যান্ডু গেঞ্জি অথবা বুক খোলা জ্যাকেট পরে প্রায় খালি গায়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলে মেয়েরা! বাসায় ফিরে নিউজ দেখলাম। ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারী আজ আশাবাদী হবার মতো একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তার এই বিবৃতিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শংকায় শংকিত অনেক বাঙালি স্টুডেন্টদের জানে পানি এসেছে। নিয়মভঙ্গ করা এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও সেচ্চাচারিতার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া বা সাস্পেনশনে থাকা কলেজগুলোর ছাত্রদের ভাগ্য ঝুলে ছিলো। এমনিতেই থাকার জায়গা নেই।

পেটে খাবার নেই। কাজ নেই। তার উপরে কলেজের ডিক্লারেশন স্থগিত। ভয়াবহ অবস্থা। আজ ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র সচিব এলান জনসন বলেছেন, অনিয়মের কারণে কোনো কলেজ বন্ধ হলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোকেই নিতে হবে।

এ জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা দায়ী হবে না। আজকের সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে আরো যে সংবাদটি ছেপেছে, তাহলো, গত কয়েকদিন ধরে ব্রিটেনে ইসলামফোরিয়া ছড়ানো হচ্ছে। ইষ্ট লন্ডন মসজিদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ব্রিটিশরা বিক্ষোভ করছে। ব্রিটিশ মিডিয়া ব্রিটেনের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপ-প্রচার চালাচ্ছে। ব্রিটেনের বর্ণবাদী সংগঠন ‘ইংলিশ ডিফেন্স লিগ’ ওয়েষ্ট মিনিস্টার পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করছে ইষ্ট লন্ডন মসজিদ এবং লন্ডন মুসলিম সেন্টার বন্ধের দাবিতে।

ব্যাপারটি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। পার্লামেন্টে ইসলামের বিরুদ্ধে এই নেতিবাচক প্রচারণা ও ইসলামফোবিয়া ছড়ানোর বিরুদ্ধে একটি আর্লি ডে মোশন উপস্থাপন করা হয় সম্প্রতি। এতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ৫৯জন এমপি স্বাক্ষর করেন। ব্রিটিশ মিডিয়ার বাড়াবাড়ি প্রচারণা, মুসলিম বিরোধী অপপ্রচারের কারণে মুসলমানদের উপর হামলা বেড়ে যাওয়া এবং ব্রিটেনে মুসলমানদের নিরাপদ জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ব্রিটেনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ইস্ট লন্ডন পপলার কেনিং টাউনের এমপি জিমফিজ পার্টিক অবশ্য অই নিন্দা ও উদ্বেগপত্রে স্বাক্ষর করেন নি।

তিনি স¤প্রতি ব্রিটেনে মুসলিম বিরোধী প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন। ৫৯ জন এমপি স্বাক্ষরিত অই ‘মুসলিম ইন ব্রিটেন’ শীর্ষক আর্লি ডে মোশনে বলা হয়, সমাজের একটি বিশেষ অংশকে টার্গেট করার মাধ্যমে নিছক বিরোধই সৃষ্টি হবে। এতে সিভিল লিবার্টি এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত হবে। মোশনে ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রশংসনীয় অবদানের কথা স্মরণ করে পার্লামেন্টের সামনে মুসলিম বিরোধী বিক্ষোভ ও প্লেকার্ড প্রদর্শনের গভীর নিন্দা জানানো হয়।

সম্প্রতি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাবেক কর্ণধার ডঃ রবার্ট ল্যামবার্ট এবং লন্ডন সিটিজেন সংস্থার কর্ণধার নেইল জনসন মুসলিম বিদ্বেষী এই প্রোপান্ডার সমালোচনা করে বলেন, ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপ চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। এদেশের মুসলিমদের গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত করছে। সংখ্যালঘু মুসলমানরা যখন নিজেদের মেইন ষ্ট্রিম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করছে, তখন মিডিয়ায় ঘাপটি মেরে থাকা মুসলমান বিদ্বেষীরা এটা সহ্য করতে পারছে না। জনসন ব্রিটেনে বসবাসরত ক্যাথলিক ও ইহুদী কমিউনিটি ইতিহাস টেনে বলেন, এসব কমিউনিটি যখন মূলধারার ব্রিটিশ সমাজে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলো, তখন তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরণের অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এটা দুঃখজনক।

ভাবনাগুলো আচ্ছন্ন করে ফেললো আমাকে। একবুক ভাবনা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম। প্রতিদিন রাত জেগে শরীরের উপর অত্যাচার করার কোনো অধিকারি আমার নেই... ...চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।