বোকারা ভাবে তারা চালাক, চালাকরা ভাবে তারা চালাক। আসলে সবাই বোকা। বোকার রাজ্যে আমাদের বসবাস
পরের দিন সকাল ছয়টায় ঘর হতে বের হতে হবে জেনেও রাতে ঘুমাতে যেতে অনেক দেরী করেছিলাম। তাই যখন এলার্ম ঘড়ির মিষ্টি সুর একটু একটু করে তন্দ্রা হটিয়ে চেতনা ফেরত দিচ্ছিল, তখন শরীর চাচ্ছিল আরেকটু নিদ্রার কোলে খেলা করতে। কিন্তু বন্ধু মনার ক্ষ্যাপাটে রাগী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সব ঘুম এক দৌড়ে পালালো।
সকাল সাড়ে ছয়টায় আমার বাসস্ট্যান্ডে থাকার কথা, এখন কয়টা বাজে? ভাবতেই লাফ দিয়ে উঠে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি ছয়টা বেজে দশ মিনিট। দ্রুত রেডি হয়ে বাইরে বেড়িয়ে কোন রিকশা পেলাম না, আমার বাসা হতে বাস স্ট্যান্ড মিনিট বিশেকের হাটা পথ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, এর মাঝে রিকশা খুজতে খুজতে জামা ভিজতে লাগলো। অবশেষে একটা রিকশা পেতে চড়ে বসলাম, আধভেজা হয়ে রওনা দিলাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে ঘড়িতে দেখি প্রায় পৌনে সাতটা বাজে, বৃষ্টির জোর বেড়েছে।
রাস্তার পাশের এক দোকানের ছাউনিতে দেখি মনা আর টুটু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই মনা মিয়ার ঝাড়ি শুরু হয়ে গেল, প্রতিটা ট্যুরে বের হলে সে সারাক্ষণ সবাইকে ঝাড়াঝাড়ি না করে থাকতে পারে না। তার ঝাড়ি থামতে জিজ্ঞাসা করলাম গাড়ীতে না বসে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সে জানালো মাইক্রোবাস এখনও এসে পৌছায় নাই। বুঝেন অবস্থা, গাড়ির খবর নাই; আর আমাকে ঝাড়ছে দেরী করলাম কেন? নিজে ভিজেছে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে, এই ঝাল আমার উপর মিটানোর ব্যার্থ প্রয়াস। সাতটার দিকে গাড়ী নিয়ে ড্রাইভার হাজির।
আমরা মালিবাগ হতে তিনজনকে, ফার্মগেট হতে আরও চারজন আর উত্তরার কাছ হতে আরও চারজনকে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে চৌদ্দজন নিয়ে যাত্রা করলাম ময়মনসিংহ’র উদ্দেশ্যে। সাথে আরেকটি প্রাইভেট কারে করে আরও চারজন। আমরা মোট আঠারো জনের দল ভ্রমণ বাংলাদেশ'র আয়োজনে গত এপ্রিল মাসে দুই দিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম ময়মনসিংহ-শেরপুর’এর উদ্দেশ্যে, লক্ষ্যস্থল গজনী, মধুটিলা, লাউচাপড়া ঘুরে বেড়ানো।
সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরছিল বাইরের দিকে, আর আমরা চৌদ্দজন ভ্রমণচারী একটি ছোট্ট মাইক্রবাসের কাঁচে ঘেরা বক্সে করে চলতে লাগলাম ময়মনসিংহ’র দিকে। টঙ্গি পেরুনোর সময় ঘণ্টা দেড়েক আটকে রইলাম অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামে।
তখনো সকালের নাশতা করা হয় নাই কারো, সাথে করে আনা পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘বাকরখানি’ রুটি চিবুতে শুরু করলাম গাড়ীতে বসে বসে। সকাল নয়টার দিকে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম রাস্তার ধারের এক রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে নিতে। রাস্তায় শুধু গাড়ী আর গাড়ী, জ্যামে বসে থেকে থেকে বোর হওয়া ছাড়া আর কি করার। কেউ কেউ হেডফোন কানে গুঁজে দিয়ে গান শুনতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল, কেউ জুড়ে দিল রাজনৈতিক আলোচনা। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা জার্নি শেষে আমরা পৌঁছলাম ময়মনসিংহ, এখানে নজরুল স্মৃতি সংগ্রহশালা দেখা, কিছুটা যাত্রা বিরতি সাথে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেওয়া।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর স্মৃতি বলয়ে ঘেরা ত্রিশাল এখন নজরুল পল্লী হিসাবে খ্যাত। ত্রিশালে জাতীয় কবির জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে। কাজী রফিজ উল্লাহ্ দারোগা ১৯১৪ সালে আসানসোলের রুটির দোকান থেকে কিশোর কবি নজরুলকে ত্রিশালে কাজীর শিমলায় নিজ গ্রামে নিয়ে আসেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল কাজীর শিমলা মোড় থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার পশ্চিমে দারোগা বাড়ি। এখানে রয়েছে দুই তালা বিশিষ্ঠ নজরুল পাঠাগার ভবন।
মানুষকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কবির অন্যবদ্য সৃষ্টি গুলো এখানে রয়েছে। এখানে ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে আমরা ময়মনসিংহ-শেরপুর রোড ধরে এগিয়ে গিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এরপর বিকেল ছয়টা নাগাদ পৌঁছলাম শেরপুর! মাত্র সোয়া দুইশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দশ ঘণ্টা সময় লাগল! ধন্য ধন্য, বলি তারে......
সন্ধ্যা নাগাদ শেরপুরের “হোটেল সম্পদ প্লাজা (আবাসিক)” এ উঠলাম আমাদের ১৯ জনের (মাইক্রবাসের ড্রাইভারসহ) দল। মজার ব্যাপার হল মন্দা ব্যাবসা’র কারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সিঙ্গেল রুম নিতে বাধ্য করল, ফলে ১৯ জনের জন্য ১৮টি রুম নিতে হল! যাই হোক সবাই ফ্রেশ হয়ে নিচে রিসিপশনে একে একে জড়ো হলাম, সিদ্ধান্ত হল চা-নাশতা খেয়ে শহরটা ঘুরতে বের হব। হোটেলের ম্যানেজার জানালেন যে শহরে বাণিজ্য মেলা চলছে, আমরা সেখানে যেতে পারি।
নাশতা সেরে শহরে ঘুরতে ঘুরতে আমরা হাজির হলাম মেলা প্রাঙ্গনে। ছেলেরা মাঠে বসে পড়লাম আড্ডা দিতে, মেয়েরা স্টলে স্টলে ঘুরতে লাগল কিছু কেনা যায় কি না এই আশায়। হায়রে মেয়ে সকল!
মাঠে আড্ডা’র মাঝে জুবায়ের ভাই বলল সবাইকে সিনেমা দেখাবেন, সিনেমার প্রসঙ্গ এলো কারণ আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে একটি পুরাতন সিনেমা হল। যেই ভাবনা সেই কর্ম শুরু। ভ্রমণসাথী রাসেল রওনা হল সিনেমা হলের দিকে।
খোঁজ নিতে সিনেমা হল, এর পরিবেশ, কি ছবি চলছে তার ডিটেইল ইত্যাদি জানতে। কেননা আমরা নাইটশো’তে সিনেমা দেখবো! সিনেমা কেমন ছিল এ নিয়ে একটি সিনেমা রিভিউ লেখার ইচ্ছা আছে, সেখানে এ ব্যাপারে ব্যাপক বিনুদন হবে। শুধু বলে রাখি আধঘণ্টা দেখতেই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। শেষে হোটেলে এসে রাত দেড়টা পর্যন্ত আমার রুমে কিছু নিয়মিত ভ্রমণবন্ধু আড্ডায় মেতে রইল। এতো লম্বা জার্নি শেষেও ক্লান্তি নেই, যদিও মনা ভাই বোলে দিয়েছে সকাল সাতটায় আমরা রওনা দিব তারপরও ঘুমোতে গেলাম রাত দুটোয়।
সকাল পাঁচটায় টুটু ভাইয়ের হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হল। ছয়টা নাগাদ রেডি হয়ে রুম তালা মেরে নিচে রিসিপশনে এসে দেখি কোথাও কেউ নেই। একে একে সবাই রেডি হয়ে জড়ো হতে হতে সাড়ে ছয়টার উপরে, তড়িঘড়ি করে গাড়ী ছাড়া হল। ঘণ্টাখানেক চলার পর গাড়ী থামানো হল সকালের নাশতা করে নেয়ার জন্য। লোকাল এলাকায় ১৫-২০ জনের জন্য নাশতা তৈরি করে সার্ভ করা একটু ঝামেলার।
এখানে ঘণ্টাখানেক নষ্ট করে আমরা আবার রওনা হলাম।
প্রথমে আমরা গেলাম জামালপুরস্থ (শেরপুর হতে বেশ কাছে) “লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র”। দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। শাল আর গজারি বন আচ্ছাদিত ঘন সবুজের পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো, ছোটাছুটি ও লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশের কোলে হেলে থাকা পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতির ফাঁকে ফাঁকে স্বচ্ছ জলের আঁকাবাঁকা লেকের বাহার।
আলো-আঁধারির এসব লেকে রাজহংস পালের জলকেলিতে মাতামাতি। লেকের ওপর ঝুলন্ত ব্রিজে হিমশীতল বাতাসের পরশে গা জুড়ানো। লেক ঘেঁষা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পিচঢালা দীর্ঘ আঁকাবাঁকা ছায়াসরুঁ পথ। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার দেবদারম্নবেষ্টিত সর্পিলাকার সিঁড়িপথ পেরিয়ে পাঁচতলার ওয়াচ টাওয়ার। ক্রিসমাস ট্রিতে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল ডাকবাংলো, শিশুদের দোলনা।
পাহাড় আর টিলায় টিলায় গারো আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা।
জামালপুরের 'লাউচাপড়া' অবসর বিনোদন কেন্দ্রের এই নৈসর্গিক ও ছায়াশীতল পরিবেশ দর্শনে বছরজুড়ে ভিড় করছেন দেশ-বিদেশের শত শত পর্যটক। জামালপুর জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা বকশিগঞ্জ। আর শেরপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা শ্রীবর্দী। অবসর বিনোদন কেন্দ্র লাউচাপড়ার অবস্থান বকশিগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি জনপদে হলেও শ্রীবর্দী উপজেলার কর্ণজোড়া বাজার থেকেও বেশি দূরে নয়।
বকশিগঞ্জ থেকে ১৫ আর শ্রীবর্দী থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরের পর্যটন কেন্দ্র লাউচাপড়া। বকশিগঞ্জ ও শ্রীবর্দীর দু'টি পথ এক হয়ে মিলেছে চোখ জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের আধার বলে খ্যাত লাউচাপড়ায়। এক সময় ঘন বন জঙ্গলের এসব পাহাড়-টিলায় শত প্রজাতির বন্যপ্রাণী থাকলেও এখন তা কমে গেছে। শূকর, বানর, বনমোরগ আর হাতির পাল ছাড়া এই বনে তেমন কোন প্রাণীর দেখা মেলে না এখন। তারপরও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের ভিড়ে বছরজুড়ে উৎসবমুখর থাকছে ছায়াশীতল নৈসর্গিক লাউচাপড়া।
ঘণ্টাখানেক এখানে বেড়ানোর পর আমরা রওনা হলাম “গজনী”র উদ্দেশ্যে। না ভাই ভারতীয় সিনেমা “গজনী” নয়, এটা বাংলাদেশের শেরপুরস্থ “গজনী অবকাশ কেন্দ্র”।
শেরপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আতাউর রহমান মজুমদার ১৯৯৩ সালে জেলা সদর থেকে ৩১, ঝিনাইগাতী থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে গারো, কোচ, হাজং, আদিবাসী অধু্যষিত গারো পাহাড়ে নির্মাণ করেন অবকাশ ভবন ও অবকাশ বনভোজন কেন্দ্র। তাঁর অল্প সময়েই অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ রেখে তিনি চলে যান। পরবর্তী জেলা প্রশাসক মোঃ নওফেল মিয়া ও বর্তমান জেলা প্রশাসক মোঃ নাছিরম্নজ্জামান বনভোজন কেন্দ্রটি উন্নয়নের জন্য ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।
বর্তমানে তিনি কৃত্রিম জলপ্রপাত তৈরি করছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজন রয়েছে এখানে। হ্রদের মাঝেও কৃত্রিম দ্বীপ। দ্বীপে যাতায়াতের জন্য স্টীলবোটের ওপর নির্মিত দোলনা সেতু। হ্রদের পানির ওপর দিয়ে বেসরকারী উদ্যোগে দৃষ্টিনন্দন রেসত্মরাঁ ও বিলাশবহুল রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে অবকাশ কেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে তিলোত্তমার ছোঁয়া।
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানি করেছে রংবেরঙের ৮টি প্যাডেল চালিত বোট। প্রতিবোটে একসঙ্গে ৪জন ভ্রমণ করতে পারেন অনায়াসে। প্রতিটি বোটে জনপ্রতি খরচ পড়ে ২৫ টাকা। হ্রদের প্রানত্মে রয়েছে সুবিন্যসত্ম কজওয়ে। পাহাড়ী ঝর্ণার পানি বাঁকে বাঁকে হ্রদে এসে মিশেছে।
আর সে পানি ফুলেফেঁপে পাথরে বাঁধানো ঘাট দিয়ে জলপ্রপাত হয়ে আবার ঝর্ণাধারায় হারিয়ে গেছে অজানায়। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে বৈদু্যতিক বাতি, পানি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ ছয় কক্ষবিশিষ্ট আধুনিক দোতলা রেস্ট হাউজ এবং মসজিদ। রেস্ট হাউজের প্রতিকক্ষের ভাড়া ৫শ' টাকা। রেস্ট হাউজ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে নামার জন্য রয়েছে পদ্মসিঁড়ি। পদ্মসিঁড়ির পাশেই কাব্যপ্রেমীদের জন্য কবিতাঙ্গনের গাছে গাছে ঝোলানো আছে প্রকৃতিনির্ভর রচিত কবিতা।
পাহাড়ের পাদদেশে বর্ষীয়ান বটবৃক্ষের ছায়াতলে শান বাঁধানো বেদিসহ বিশাল চত্বরে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা, পিকনিকে আসা দলগুলোর আড্ডা ও খেলাধুলায় মেতে ওঠার জন্য প্রচুর জায়গা । বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নলকূপ। পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন 'সাইট ভিউ টাওয়ার'। টাওয়ারের চূড়ায় উঠে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যকে অবলোকন করা যায়। অবকাশ কেন্দ্রের প্রবেশপথে রাসত্মার দুই পাশে সৃষ্ট ঘোড়ার ক্ষুরের ক্রিসেন্ট লেক, লেকের তীর থেকে পশ্চিমে অবস্থিত আরেকটি লেকের তীরে যাওয়ার জন্য পাহাড় ও রাসত্মার তলদেশে খনন করা হয়েছে রোমাঞ্চকর সুড়ঙ্গপথ 'পাতালপুরী।
ক্রিসেন্ট লেকের মাঝখানে নির্মিত হয়েছে জলপ্রপাত 'নির্ঝর'। এর পূর্ব পাশে রোপিত কৃত্রিম পদ্মপাতা ও পদ্মকলির অবয়বে 'পদ্মরানী'। সাইটভিউ টাওয়ারের পাশেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ১১ নং সেক্টরের শহীদদের স্মরণে নির্মিত 'মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ভাস্কর'। এছাড়াও অবকাশ কেন্দ্রের প্রাচীন বটবৃক্ষের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে কাঠে তৈরি অবকাশ 'ইউটোপিয়া'। গাছের গোড়া থেকে লতানো সিঁড়ি দিয়ে এখানে ওঠা যায়।
হ্রদ পেরিয়ে পশ্চিমে পাহাড়ে যেতে হবে বর্ণিল সংযোগ সেতু 'রংধনু'। ইকোপার্ক, অর্কিড হাউজসহ আরো কিছু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র বর্তমানে সিনেমা ও নাটকের শূটিং লোকেশন হিসেবেও পরিচিতি অর্জন করেছে। থাকা-খাওয়াসহ আইন-শৃঙ্খলার কোন সমস্যা নেই। পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ক্যাম্প।
এই পাহাড়ী এলাকায় আরও একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হচ্ছে গারো, কোচ, হাজং, বানাই, ঢালুসহ নানান সমপ্রদায়ের বসবাস। গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে পিছঢালা পথ। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে গজনী পৌঁছতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। পথে কোন ফেরির বালাই নেই। একটানা চলে আসা যাবে গজনী অবকাশে।
বন্ধুবান্ধব ও পরিবারপরিজন নিয়ে ঘুরে আসুন প্রকৃতির লীলাভূমি গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশ কেন্দ্র। অবকাশ কেন্দ্র ছাড়াও আছে শেরপুর জেলা সদরের নামীদামী আবাসিক হোটেলের সুবিধা। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যনত্ম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলে রাত যাপন করা যায়। অবকাশ কেন্দ্রে যেতে হলে প্রতি গাড়ির জন্য ১৫০ টাকা এবং অবকাশ রেস্ট হাউজ ব্যবহারের জন্য প্রতিকক্ষ ৫০০ টাকার বিনিময়ে পাস সংগ্রহ করতে হবে।
গজনী থেকে বেড়িয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম টাইম কাভার করতে লাঞ্চ পোস্টপণ্ড করে এখন চলে যাবো “মধুটিলা ইকোপার্ক”।
সেখানে পৌঁছানোর পর পার্কের পাশের একটা লোকাল খাবারের রেস্টুরেন্টে আমাদের ১৯জনের দলের খাবারের অর্ডার দিয়ে ঢুকে পড়লাম ইকোপার্কের ভেতরে।
প্রকৃতির ঘন সবুজে ছেয়ে থাকা সারি সারি গাছের হাতছানিতে প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ। এরপর চারদিকে তাকিয়ে দেখার পথ দেখায় পথই। প্রবেশ পথের ডান পাশে খোলা প্রান্তর আর দু’পাশে রকমারি পণ্যের দোকান। সামনের ক্যান্টিন পার হলেই পাহাড়ী ঢালু রাস্তা।
এর পরই অবাক করে হাতি, হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বানর, কুমির, ক্যাঙ্গারু, মৎস্যকন্যা, মাছ ও পাখির ভাষ্কর্য। পাশের আঁকাবাঁকা পথে ঘন গাছের সারি লেকের দিকে চলে গেছে। তারপর স্টার ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে আরোহণ করলেই নজর কেড়ে নেয় ভারতের উঁচু-নিচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত এই মধুটিলা ইকোপার্ক এখন অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র এবং একটি আধুনিক পিকনিক স্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পোড়াগাঁও ইউনিয়নে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জের সমশ্চূড়া বনবিটের আওতায় ৩৮০ একর বনভূমিতে গারো পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে এলাকার সংসদ সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে সরকারীভাবে ২০০০ সালে নির্মিত হয় ‘মধুটিলা ইকোপার্ক’ তথা পিকনিক স্পট।
স্থাপনকাল থেকেই শীত মৌসুমে এ পার্কে পর্যটকরা ভিড় করে। ইকোপার্কে ঢুকতে জনপ্রতি পাঁচ টাকায় টিকেট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আলাদা আলাদা ফি দিয়ে প্যাডেল বোট চালানো, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠা, শিশুপার্কে প্রবেশের সুযোগও রয়েছে। শুধু দিনের বেলায় ব্যবহারের জন্য ভ্যাটসহ ৪ হাজার ৭০২ টাকার বিনিময়ে পাহাড়ের চূড়ায় চার কক্ষ বিশিষ্ট শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) সুসজ্জিত ‘মহুয়া’ নামের রেস্ট হাউজ। এ রেস্ট হাউজ ব্যবহার করতে চাইলে মধুটিলা রেঞ্জ অফিস, ময়মনসিংহ অথবা শেরপুর বন বিভাগ অফিসে বুকিং দিতে হয়।
এ ছাড়াও এখানে রয়েছে ডিসপ্লে মডেল, তথ্য কেন্দ্র, গাড়ি পার্কিং জোন, ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, বন্য প্রাণীর বিরল প্রজাতি পশুপাখির ভাষ্কর্য। আরও আছে ঔষধি ও সৌন্দর্যবর্ধক প্রজাতির বৃক্ষ এবং ফুলসহ বিভিন্ন রঙের গোলাপের বাগান।
ইকোপার্কটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখান থেকে ভারতের দূরত্ব ১ কিলোমিটার। যুগ যুগ ধরে সীমান্তবর্তী এ পাহাড়ে গারো আদিবাসীরা বসবাস করে আসছেন। এখানে খুব সহজে আদিবাসী গারোদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি খুব কাছে থেকে দেখারও সুযোগ রয়েছে।
সরকার প্রতি বছর এ পার্ক থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার রাজস্ব আয় করলেও পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সে অনুপাতে কোন প্রকার নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পার্কের আরো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ঝুলন্ত ব্রিজ, লেক এক্সটেনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে মধুটিলা ইকোপার্কের দূরত্ব প্রায় ২শ’ কিলোমিটার। ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর আসতে হবে। শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী বাজার পর্যন্ত লোকাল বাস সার্ভিস রয়েছে।
অথবা নিজস্ব গাড়িতে সরাসরি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর পৌঁছানোর আগে নকলা উপজেলা থেকে নালিতাবাড়ী সদর হয়ে ইকোপার্কে আসা সহজ হয়।
তিনটা নাগাদ আমরা বেড়িয়ে এলাম পার্ক থেকে, হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে আগে অর্ডার করে যাওয়া ভাত-মুরগির মাংস-আলু ভর্তা-ডাল দিয়ে লাঞ্ছ সেরে নিলাম। জুবায়ের ভাই সবাইকে খাওয়ালেন ডাবের পানি। পাঁচটা নাগাদ গাড়ী ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ল, এই আশা ছিল যে দশটা-এগারোটা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছব। কিন্তু বিধিবাম, পথে তিনবার গাড়ী নষ্ট হল, খারাপ রাস্তা সব মিলে ঢাকা পৌঁছলাম রাত একটায়! বাসায় এসে হিসেব করে দেখলাম মোট ৪২ ঘণ্টায় প্রায় ৬০০ কিলোমিটার জার্নি করেছি, তিন জেলা ময়মনসিংহ, শেরপুর আর জামালপুর ভ্রমণ করে দেখেছি ত্রিশালের কাজীর শিমলাস্থ “নজরুল স্মৃতি সংগ্রহশালা”, “লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র”, “গজনী অবকাশ কেন্দ্র” আর “মধুটিলা ইকোপার্ক”।
সাথে বোনাস হিসেবে ছিল আড্ডা আর নাইটশোতে আধঘণ্টার জন্য “জটিল প্রেম” নামক বাংলা সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা।
তথ্যসুত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।