রাজধানীর সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলো বহুমুখী সংকটের বোঝা নিয়ে ধুঁকছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বহু স্কুল ভবনের জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে ঝুঁকি নিয়েই শিক্ষার্থীরা পাঠ নিচ্ছে। নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ স্কুলের নেই খেলার মাঠ। রয়েছে তীব্র শিক্ষক সংকট। টয়লেট এবং পানীয় জলের সুব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিও সীমাহীন। বিশেষজ্ঞরা এ সংকটকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, প্রাইমারি স্কুলের উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের প্রাইমারি স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে তা রক্ষা করা হচ্ছে না।
জরাজীর্ণ অবকাঠামো : রাজধানীর অধিকাংশ প্রাইমারি স্কুলই পুরনো ও জরাজীর্ণ। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেরই নেই পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা। নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত স্কুল ভবনগুলোর অধিকাংশই এখন বয়সের ভারে জরাজীর্ণ। অনেক স্কুল ভবনে দেখা দিয়েছে বড় ফাটল। খসে পড়েছে পলেস্তারা ও চুন-সুড়কি। স্কুল ভবনের ছাদ চুঁইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। স্কুল ভবনের দেয়ালে জন্ম নেয় বিভিন্ন পরগাছা। এসব প্রাইমারি স্কুলে রয়েছে শিক্ষা উপকরণের সংকটও। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নগরীর সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর অধিকাংশই পুরনো স্থাপনার। এর কোনো কোনোটি উনিশ শতকে নির্মিত। নগরীর বাড্ডা সরকারি প্রাইমারি স্কুল ১৮৯৫ সালে নির্মিত। তেমনি মৌলভীবাজার সরকারি প্রাইমারি স্কুল নির্মিত ১৯৬৩ সালে। এরকম অসংখ্য স্কুল ভবন রয়েছে শতবর্ষী। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি অনুদান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের এক প্রকার বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ স্কুলগুলোতে ক্লাস করতে হচ্ছে। মহুৎটুলী সরকারি প্রাইমারি বয়েজ অ্যান্ড গার্লস স্কুল এমনই একটি উদাহরণ। এটি পুরান ঢাকার কোতোয়ালির আবুল খায়ের রোডে অবস্থিত। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। কিন্তু দীর্ঘ ৮৭ বছরেও স্কুলটির মূল ভবনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দেয়ালের চুনকাম খসে পড়েছে বহু আগে। ক্ষয়ে গেছে তিনতলার জরাজীর্ণ টিনের ছাদটি। ঝড়-বৃষ্টি হলেই এখন ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। ভিজতে হয় শিক্ষার্থীদের। স্কুলের বিভিন্ন ক্লাস রুম ঘুরে দেখা যায়, মেঝের সিমেন্ট খসে জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে পড়েছে। বেহাল অবস্থা ক্লাস রুমের সিলিং ও দেয়ালের। রংবিহীন বিবর্ণ দেয়ালে ধরেছে ফাটল।
নেই খেলার মাঠ : অন্যদিকে ঢাকার প্রাইমারি স্কুলগুলো ক্রমেই খেলার মাঠবিহীন নিরানন্দ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। ফলে খেলার মাঠ ছাড়া শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় শরীরচর্চার সুযোগ পাচ্ছে না। একই সঙ্গে মাঠে খেলতে না পেরে তারা কাটাচ্ছে নিরানন্দ শৈশব। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর প্রাইমারি স্কুলগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ভেতরে সরু রাস্তার পাশে অবস্থিত। স্কুলগুলোর খেলার মাঠ না থাকায় পাঠ বিরতিতে শিক্ষার্থীদের রাস্তার উপর খেলতে দেখা যায়। মিরপুরের পল্লবী ২১ নম্বর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠটি দখল করে নতুন স্কুল ভবন তৈরি করায় এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পাশের একটি হাইস্কুলের মাঠে খেলতে যায়। কিন্তু স্কুলটির দারোয়ান তাদের মাঠে ঢুকতে দেয় না। এতে শিক্ষার্থীদের প্রায়ই মাঠের অভাবে প্রধান সড়কে ঝুঁকি নিয়ে খেলতে দেখা যায়।
তীব্র শিক্ষক সংকট : পল্লবী ২১ নম্বর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর কয়েকজন শিক্ষার্থীর বক্তব্য, 'আমাদের ক্লাসে এত বেশি শিক্ষার্থী যে প্রায়ই চিল্লাচিলি্লতে পড়া শোনা যায় না। আমাদের শিক্ষকরা এ অবস্থায় আমাদের সামলাতে হিমশিম খায়। এতে পড়ালেখায় সমস্যা হয়।' এ শিক্ষার্থীদের মতো একই সমস্যা রাজধানীর অন্য প্রাইমারি স্কুলগুলোতেও। এ স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি কিন্তু শিক্ষক কম। একজন শিক্ষককেই নিতে হয় একাধিক ক্লাস। অন্যদিকে নগরীর প্রাইমারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোচিংয়ের ক্লাস হয় স্কুলের মধ্যেই। স্কুলের শিক্ষকরা সাধারণত ৫০০ টাকা সম্মানীর বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং দিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা মূল ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে ক্লাস নিতে বেশি আগ্রহী। লক্ষ্য করা যায়, প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক তুলনামূলক কম। এক্ষেত্রে সেই শিক্ষকের মানসিক চাপ বেশি থাকে। পড়ানোর মান কমে যায়। তবে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা নানা রকম বঞ্চনারও শিকার হয়ে আসছেন। উচ্চ শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও নগরীর প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকরা একজন গাড়িচালকের চেয়েও কম বেতন পাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকরা নিজেদের পদায়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে আন্দোলন করে এলেও এখনো আশার আলো দেখতে পাননি। এ অবস্থায় অনেকেই নিরাশ হয়ে পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা আরও তীব্র হচ্ছে। বকশীবাজার সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সাহাবুদ্দিন শেখ বলেন, উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও আমাদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা শিক্ষকদের জন্য অপমানজনক। হতাশ হয়ে অনেক শিক্ষকই এখন পেশা ছাড়ছেন।
এদিকে দেশের প্রাইমারি স্কুলগুলোর উন্নয়নে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি)-৩ নামক প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত, শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। কিন্তু শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগেও প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের মতে, শুধু সরকার একা নয়, প্রাইমারি স্কুলগুলোর উন্নয়নে স্থানীয় সরকার ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারকে প্রাইমারি স্কুলগুলোর উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেটও বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রাইমারি স্কুলের উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমাদের প্রাইমারি স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে তা হয় না। এমনকি স্কুল সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটও বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে সরকারের ম্যানেজিং কমিটিগুলোর তৎপর হওয়া প্রয়োজন। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়ালেই চলবে না, বাড়াতে হবে বাজেটের বরাদ্দও।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।