আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গডফাদার ও তাঁদের ধর্মপুত্ররা

‘রানা’রা এখন বাংলাদেশের আঞ্চলিক রাজপুত্র। নেপালের সাবেক রাজপরিবারের যে পুত্রটি ‘রাজা’ হন, তাঁর উপাধি হয় রানা। রাজপুত ভাষায়ও রানা মানে রাজপুত্র বা রাজা। আমাদের রানারা সাধারণ ঘরেই জন্মান। কিন্তু ‘রানা’ নামের সার্থকতা প্রতিষ্ঠা তো আর সাধারণ যোগ্যতায় হয় না।

যাঁর ঔরসে তাঁদের জন্ম তিনি জন্মপিতা, আর যাঁর আশ্রয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠা তিনি ধর্মপিতা বা গডফাদার।
একদা ইতালি গডফাদারদের স্বর্গরাজ্য ছিল। আইনকানুনের তেমন বালাই ছিল না। সে সময়ই ইতালি দেশে কথা চালু হয়, দুনিয়াটা এতই কঠিন জায়গা যে লোকের আর একটা ফাদার হলে চলে না, গডফাদারও লাগে। সে সময়ের ইতালির সঙ্গে এ সময়ের বাংলাদেশের মিলের মধ্যে বড় মিল হলো, এখানেও কিছু বীরপুঙ্গব জন্মান, যাঁরা আর বাপের সন্তান থাকতে রাজি নন, গডফাদারের ধর্মপুত্র হওয়ার সাধনায় নামেন।

এই সাধনায় অনেক পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। গডফাদার নেতার জয়ধ্বনি দেওয়া মিছিল নামাতে হয়, তাঁর হয়ে মারামারি করতে হয়, গডফাদারের গোপন ব্যবসার খুঁটি হতে হয়। বিনিময়ে ধর্মপুত্র ছাত্রনেতা থেকে যুবনেতা হন। যুবনেতা থেকে জননেতা করার আশ্বাসও দেওয়া হয় তাঁকে। গডফাদার ও তাঁর ধর্মপুত্রদের জোড়া লাগানোর রসায়ন হলো বিশ্বাস আর আনুগত্য।

গডফাদার প্রতিশ্রুতি দেন, ধর্মপুত্রকে তিনি ক্ষমতার উচ্চ নম্বরের সিঁড়িতে টেনে তুলবেন, প্রতিষ্ঠা দেবেন; সেখান থেকে পড়ে গেলে রক্ষাও করবেন। একদিন জনগণ দেখতে পায়, গডফাদার প্রকাশ্যে রানার কপালে চুম্বন করে সন্তানের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। রানাদের জীবনে সেই দিনটা পরম সুখের আর গর্বের।
তারপর একদিন যখন নিজের পাপের ভবনের নিচে নিজেই চাপা পড়ে থাকেন, তখন সবার আগে গডফাদারই আসেন তাঁকে উদ্ধার করতে। লোকচক্ষু আর মিডিয়ার শক্তিশালী ক্যামেরার দৃষ্টি থেকে এত দূর নিয়ে যান যে রানা পাখি হয়ে উড়ে যান একেবারে সীমান্তের দিকে।

এ রকম অনেক ‘রানা’ই এভাবে বিপদে পড়ে উড়ে গেছেন বিভিন্ন দেশে। মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রীয় খাঁচায় ঢোকা বা বিদেশে পলায়ন করা রানাদের কাজের অংশ। সেখানেও গডফাদারের লম্বা হাত তাঁকে ভরসা দেয়। প্লাস্টিকম্যানের মতো সেই লম্বা হাত থানা থেকে আদালত, মিডিয়া থেকে মন্ত্রণালয়—সবখানেই পৌঁছায়। এভাবে কোনো রানা যদি বা বন্দীও হন, গারদের ভেতর তাঁরা দিন গোনেন, একদিন গডফাদার আসবেন, একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবেন।

দূর আকাশের বিদেশ পানে খুশিতে বেড়াবেন।
পাঠক, আগে দেখে আসি রানার যৌবনকালটা। মার্কিন সাময়িকী কাউন্টারপাঞ্চে প্রবাসী মার্কিনঅধ্যাপক বিজয় প্রসাদ লিখেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সোহেল রানা খুবই নাম-ডাকওয়ালা চরিত্র। ছোটবেলায় তাকেই তো দেখি রাস্তার কোণে দুর্ধর্ষ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। চাঁদার জন্য হুমকি দিত আবার চাঁদা পেলে দেখেও রাখত।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো বিশ্বায়নের চুক্তিতে ঢুকলে, পাড়ার মাস্তান সোহেল রানা অফিস খোলে। সেখানে সাইনবোর্ড ওঠে: ল্যান্ড ডেভেলপার অথবা ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ইত্যাদি। সস্তা পোশাক ছেড়ে গায়ে চড়ায় দামি ব্র্যান্ডের পোশাক। ধারালো ইমেজের জানান দিতে বাড়িয়ে ধরে চমৎকার বিজনেস কার্ড। তাদের মাস্তানিবিদ্যা ভাড়া নেয় বড় রাজনৈতিক দলগুলো।

তারা হয়ে ওঠে দলের যুবসংগঠনের নেতা, জনসভায় জোগান দেয় মানুষ আর কেনে বস্তির ভোট। বাজার অর্থনীতি জেঁকে বসলে এসব পাড়ার মাস্তান রিয়েল এস্টেট ব্যবসা খুলে বসে। গায়ের জোরে বা সামান্য মূল্যে সাধারণ মানুষের জমি হাতিয়ে নেয় কিংবা গডফাদারদের ছত্রচ্ছায়ায় অন্যের জমি দখল করে। এসব জমি তারা প্লট করে বিক্রি করে কিংবা তার ওপর বানায় আলিশান ভবন। সে তখন যাতেই হাত দেয়, সেখান থেকেই টাকা বানায়।

এই টাকা দিয়ে নতুন রানাদের পোষে। নিজের অঞ্চলে সে নিজেই রাজপুত্র। এলাকাই তার সব। ’
সেখানে তিনি তাঁর নাম সার্থক করেন। এভাবে যদি তাঁর ভবন না ধসে, যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে মারতে না পারে, যদি কখনো জনগণের বিদ্রোহে তাঁর পতন না হয়; তাহলে রাজপুত্র রানা আঞ্চলিক রাজা হয়ে ওঠেন।

গডফাদারের ধর্মপুত্ররা এভাবে একদিন নিজেই গডফাদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। দুর্ভাগ্য রানার যে গডফাদার হয়ে ওঠার ঠিক আগমুহূর্তেই নিজেরই পাপের সৌধ তাঁর ওপরই ধসে পড়ল। সাভারের ‘রানা’ তাই আমাদের সমাজের সাবেকি মাস্তান চরিত্রের ধনকুবের নেতা হয়ে ওঠার কাহিনি। এক রানা কারাগারে হলেও আরও অনেক রানা যে বহাল তবিয়তেই আছেন, তা জানিয়েছেন আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী। দুই দিন আগে তিনি বলেছেন, ‘শুধু সাভারের রানা নয়, দেশে আরও অনেক রানা রয়েছে।

’ ইদানীং মন্ত্রীরা যা-ই বলেন, মানুষ হাসে নয়তো রাগে। এ রকম দিনে শুধু যোগাযোগমন্ত্রীর কথাটাই গম্ভীর। গম্ভীর হয়েই আমরা ভাবতে পারি, দেশে যদি অনেক রানা থাকেন, তাহলে তাঁদের পেলেপুষে বড় করার জন্য নিশ্চয়ই অনেক মুরাদ জং আছেন। যেমন নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার প্রতিবাদ সমাবেশে প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে হুমকিদাতা ক্যাঙ্গারু পারভেজের জন্য আছেন এক সিনেম্যাটিক গডফাদার। সেই গডফাদারের জন্যআছেন আরও বড় কেউ।

বাংলা সিনেমার নায়ক একদা গেয়েছিল ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’। আজকের রানারা, ‘আছেন আমার গডফাদার। তিনিই আমায় এনে দেবেন মন্ত্রী আর মিনিস্টার’।
আশির দশকের পাড়ার মাস্তানরা সবাই হুমায়ূন আহমেদের বাকের ভাইয়ের মতো ট্র্যাজিক গল্প জন্ম দিয়ে হারিয়ে যাননি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁদের অনেকে গডফাদার ধরে ‘রানা’ হওয়া শুরু করেন।

যুগটাই ছিল তেমন। হইহই করে মুক্তবাজার, বিশ্বায়ন ইত্যাদি চলে এল দেশে। একদিকে ভূমিহীনতা অন্যদিকে বাণিজ্যিকতা বাড়তে থাকল। প্রচুর কোটিপতি দাঁড়িয়ে গেলেন। ভূমি-নদী-জলা-বন-পাহাড় ইত্যাদি দখলের হিড়িক লাগল।

ঋণখেলাপ করে ধনী হলে যখন শাস্তি হয় না, তখন আর লজ্জা করে লাভ কী? নগরে ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার হলো, মফস্বলে ঢুকে গেল ফুটানি কালচার। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো পানির দামে বেচা হতে থাকার তালে বেকার শ্রমিকেরাও বাতাসের দরে বিকোতে থাকলেন। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের দাম এতই পড়ে গেল, পোশাকশিল্পে কিংবা বিদেশের শ্রমদাসত্বে খাটানোও সস্তা হয়ে গেল। অফুরান জনশক্তি ব্যয় হলো ধনিক শ্রেণী তৈরির কাছে। সে সময়ই হিন্দি চ্যানেলে অমিতাভ বচ্চন গমগমে কণ্ঠে ডাক দিলেন, ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’! অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বড়লোক হওয়ার রাস্তা ধরলেন।

সে সময়ের অনেক তরুণের মনের গোপন বাসনায় এক্স-রে করলে দেখা যেত, মনের ভেতর সবারই শ্রেণীহীন বড়লোকি বাসনা।
দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে পাওয়া কালোটাকার ছড়াছড়ি অর্থনীতিতে। ফরমাল অর্থনীতি আর প্রকাশ্য রাজনীতি ঝোলের ওপরের তেলের মতো ভেসে থাকল বটে, কিন্তু তলার মাছ-মাংস হয়ে উঠল ইনফরমাল অর্থনীতি ও রাজনীতি। চোরাকারবার, ভূমিদস্যুতা, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, জনগণের বা সরকারের সম্পদ লুণ্ঠনের কারবার অবাধ হলো। অর্থনীতি এভাবে লুণ্ঠন-দুর্নীতিনির্ভর হয়ে পড়লে রাজনীতিকে নিয়োজিত করা হলো এসবের প্রতিরক্ষায়।

পেশিশক্তি-অস্ত্রশক্তি-দখলশক্তির চাহিদা বেড়ে গেল। এই বিপুল দুর্বৃত্ত ক্ষমতাব্যবস্থার ধাপে ধাপে দরকার হলো বিকল্প নেতার। লুটপাটের রাজনীতি ও অর্থনীতির অশুভ বিবাহের সন্তান হিসেবে সে সময়ই জেলায় জেলায় একেকজন গডফাদার দাঁড়িয়ে গেল। গজিয়ে উঠল অজস্র গডফাদার আর তাদের ধর্মপুত্ররা। তারাই হয়ে উঠল সমাজপতি, রাজনীতির অধিপতি আর অর্থনীতির চালক।

গডফাদার মুরাদ জং ও ধর্মপুত্র রানাদের ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থা তাই এক দিনও চলতে পারবে না। চলবে না দখলদারি, শ্রমদাস ব্যবসা, সন্ত্রাস-নাশকতা আর জনগণকে দাবিয়ে রাখার রাজনীতি। এমনকি বাংলাদেশের শ্রম, সম্পদ আর প্রকৃতি নিয়ে মুনাফা করতে আসা বহুজাতিক পুঁজিও দেশীয় দোসর হিসেবে জবরদস্ত গডফাদারদের খোঁজ করে।
যোগাযোগমন্ত্রীর সত্যবচনের কয়েক দিন আগে মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারায়ণগঞ্জের জনসভায় এলান করেছিলেন যে জেলায় জেলায় গডফাদার আছে। উভয়ই সত্যদর্শন করেছেন বটে, কিন্তু যে ব্যবস্থার তাঁরা সুফলভোগী, যে ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই তাঁদের রাজনীতি; রানাদের সত্যিকার গডফাদার হলো সেই ব্যবস্থা।

রক্তের পিতাকে ত্যাজ্য করা যায় কিন্তু ধর্মপিতাকে ত্যাজ্য করার উপায় কী? ভবনের স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়া করলে ভবন ধসে না, কিন্তু ব্যবস্থার খুঁটি ধরে ধাক্কাধাক্কি করলে গডফাদার বানানোর পুরো ব্যবস্থাটাই রানা প্লাজার মতো ধসে যেতে পারে। জনগণ কিন্তু তখন উদ্ধার বা ত্রাণ—কোনোটাই এগিয়েদিতে আসবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।